রম্যরচনা: বাদুড়িয়া আছে বাদুড়িয়াতেই রামিজ আক্তার শিয়ালদাহ থেকে গোবরডাঙ্গা বা বনগাঁও লোকাল ধরুন। মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকা ভালো ...
রম্যরচনা:
বাদুড়িয়া আছে বাদুড়িয়াতেই
রামিজ আক্তার
শিয়ালদাহ থেকে গোবরডাঙ্গা বা বনগাঁও লোকাল ধরুন। মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকা ভালো যে বসতে পারবেন না ট্রেন এ, যদি কোনোরকম এ দাঁড়াতে পারেন তো ভাগ্গি ভালো আপনার। অশোকনগর-হাবড়ার পর ট্রেনটা একটু খালি খালি লাগবে আপনার। সংহতি এলে গেটের দিকে চলে আসুন। মসলন্দপুর নেমে পড়ুন। ২ নং প্লাটফর্ম ধরে রেলগেটের দিকে আসুন, ডানদিকে যশোহর মিষ্টান্ন ভান্ডার দেখতে পাবেন। ঢুকে পড়ুন ভিড় থাকলেও। ঠান্ডা মিষ্টি দই খেয়ে নিন। আরো কিছু মন চাইলে খেয়ে নিন, মনে থেকে যাবে আপনার। এবার চলুন যাওয়া যাক আমাদের দিকটায়। তেঁতুলিয়ার অটোতেই উঠুন। বেশ খানিক্ষন জ্যাম এ আটকে থাকবেন। বাঁ দিকে জ্যোতি আর পূর্বাশা সিনেমা হল দুটো দেখে নিন। এখন আর দেব বাবুর সিনেমা বাদে আর কেও তেমন ঢুকতে পারে না। কদিন আগে অবধিও প্রসেনজিৎ দাদারই রমরমা ছিল। তিন আমতলা মোড়, অরবিন্দ রোড পেরিয়ে দেশপ্রাণ ক্লাব দেখতে পাবেন। বাসন্তী পূজোতে একবার আসতে পারেন, ভালো লাগবে। এরপর ডাক্তার খানার মোড়টাতে আসুন। বাঁদিকে সুভাষচন্দ্রের একটা মূর্তি দেখতে পাবেন। নিচে লেখাটা পড়ুন। এটাই লেখা তো "নেতাজির ভারতে শেষ বক্তৃতার স্বরণে, ২৫ এ এপ্রিল ১৯৪০ সাল...." ! মূর্তিটার চশমাটা হয়তো নিচে পড়ে থাকতে পারে। স্কুলের বাচ্চাগুলো মাঝে মধ্যে সেটা পরিয়ে দেয়, দেখলেও দেখতে পারেন। বাঁদিকের মাঠের শেষে স্কুলটা মেয়েদের, চাতরা নেতাজি বালিকা শিক্ষা নিকেতন। স্কুলটা ওই শেষ বক্তৃতাকে স্বরণে রেখে। পাশেই একটা অনাথ আশ্রম, তার পাশেই একটা গ্রামীণ লাইব্রেরি। ভিতরে সময় পেলে যেতে পারেন, ধুলোমাখা বইগুলোর গন্ধটা বেশ ভালোই লাগবে। বাঁদিকের বাসুদেব মন্দির টা পেরিয়েই যে হাট টা দেখবেন, ওটাই চাতরা হাট। এই হাটেই জনসভা টা হয়েছিল সুভাষচন্দ্রের। শনিবার আর মঙ্গলবার এলে আপনাকে রাস্তা হাঁটা পথে পেরোতে হবে! হাঁটের উল্টো দিকে যে বিশালাকার স্কুলটা দাঁড়িয়ে, ওটাই দক্ষিন চাতরা হাই স্কুল, ১৯২২ সাল থেকেই ওইভাবেই দাঁড়িয়ে। আপনি ওটাকে কলেজ বলেও ভুল করতে পারেন। হাটে বাজারে কাউকে জিজ্ঞেস করুন স্কুলের ইতিহাস, আপনাকে গড় গড় করে বলে দেবে। আর একটু বয়স্ক কেও হলে স্বাধীনতার আগে থেকে বিপ্লবের ইতিহাস শোনাতে পারে। সময় থাকলে শুনতে পারেন, হরেন রায় , সূর্যকান্ত মিশ্র , আরো অনেকে কিভাবে স্কুলটার জন্যে বিপ্লব করেছিল। হাট টাতে জিলাবি খেয়ে নিন আর বাঁদিকের রাস্তাটা দিয়ে স্কুলের হোস্টেলের পাশ দিয়ে যান ৫-৬ কিমি। পপিলা গ্রামটা ছেড়ে এগিয়ে যান। এই পাপিলা গ্রাম টা আদিবাসি মানুষেরই বসবাস বেশি। আপনি যদি ওদের ফুটবল খেলা দেখেন দাদা। আমরা খেলেছি ওখানকার বন্ধুদের সঙ্গে!! হাঁফায় নাগো দাদা!! যাগ্গে, গন্তব্যে যাওয়া যাক। রসুই গ্রাম। আঁতকে উঠলেন তো? পাকিস্তানের পতাকা উড়িয়ে পাকিস্তানের অংশ হয়ে গেছে দেখেছিলেন না ফেসবুকএ? ছোটবেলায় এখানে আমরা প্রায়শঃই ক্রিকেট টুর্নামেন্ট খেলতে আসতাম। এখন হলে তাহলে ভারত-পাকিস্তান খেলা হতো বলতেন নিশ্চই। আর বেশির ভাগ সময়এ আমরাই জিততাম। মানে ভারত জিততো র কি!! খুশি হলেন তো? গ্রামের লোকগুলিকে জিজ্ঞেস করুন কি হয়েছিল ঈদের দিন। ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি ঈদের দিন চাঁদ-তাঁরা ওয়ালা কাগজের পতাকা আর ফুল দিয়ে সাজানো হয় মসজিদ এর চারপাশ। ওই চাঁদ-তাঁরা পতাকাগুলো কখনো সাদা, গোলাপি, হলুদ, সবুজ, লাল ও হয়। সমস্যাটা হল যদি সবুজ হয়ে যায়!! আর যারা এগুলো লাগায়, তাদের একবার জিজ্ঞেস করে দেখুন, পাকিস্তানের পতাকা তো দূরের কথা, ভারতের পতাকার কোথায় কি আছে বলতে পারবে না। দেখবেন দাদা, আপনি আবার ওদের anti-national নাভেবে বসেন! আমি জানি ওরা সোশ্যাল মিডিয়াতে না থেকে নিজেদের anti-social বানিয়ে ফেলেছে। ছেলে-মেয়েদের দুবেলা খাবার জোটাতে যাদের নাভিশ্বাস বেরোয়, তাদের আবার সবুজ-সাদা-কমলা! আপনার খিদে পেয়ে থাকলে কোনো বাড়িতে গিয়ে উঠুন। কলকাতা থাকে আসছেন শুনলে একটু আড়ষ্টতা থাকবে। তবুও তাজা সবজি আর মাছের ঝোল তো পাবেনই। যদি গ্রামটার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য ভালো লেগে যায়, তাহলে আর একটু এগিয়ে চারঘাটের ঝিল টার পাশে গিয়ে বসুন। প্রাণ জুড়িয়ে মাথাও ঠান্ডা হয়ে যাবে। বেশিক্ষণ থাকা ঠিক হবে না, প্রেমিক-প্রেমিকাদের আসতে অসুবিধা হয় আর কি। ওরা এখনো প্রেমটাকে ডেটিং হিসেবে ভাবতে শেখে নি। যাগ্গে, চলুন ফেরা যাক। চাতরা থেকে চলুন তেঁতুলিয়ার দিকে। ডানদিকে-বাঁদিকে মন্দির-মসজিদ দেখতে চাইলে আপনি হতাশ হবে না। মন্দির-মসজিদ এর সংখ্যাই তো বলে দেবে এখানে কারা সংখ্যাগরিষ্ঠ! তালতলার মাঠ ডানদিকে। ১৫ ই অগাস্ট এর পরের রবিবার চলে আসুন ফুটবল টুনামেন্ট কিরকম হয় দেখতে পাবেন। ঐদিন আপনাকে কেও না কেও ডেকে নিয়ে খাইয়ে দেবে দুপুরে। এরপর চন্ডিপুর বাজার পড়বে। ছোটবেলায় দাদুর কাছে শুনেছি ওটার আগেকার নাম ছিল কলোনি বাজার। ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি নাকি ওখানে কলোনি গড়েছিল। ডানদিকে দুটো বড় বড় রাধা-কৃষ্ণের মন্দির পড়বে। শেষ ৫-৬ বছরে রথযাত্রাটা বেশ জাঁকজমক করে হচ্ছে। এরপর বেনার মোড় , শিবপুর, কেওঁটসা বাজার পেরিয়ে নারকেলবেড়িয়া গ্রাম পড়বে। মনে করতে পারছেন কিছু? নাহলে আমি ই বলে দিই। তিঁতুমীর এর বাঁশের কেল্লা দাদা। ক্লাস ২-৩ তে পড়েছেন নিশ্চই। ও আপনি তো বোধহয় সিবিএসসি! তাহলে পরে কখনো বলবো। যদিও কেল্লাটা একটা ছোট বেদীতেই টিকে আছে! কারবালার পর লোকজন এখানে আসে। সে ভিড় আপনি আগে দেখেননি। আরো গেলে হুগলী গ্রাম তারপর রামচন্দ্রপুর। পদ্মা নদীটার রুগ্ন্ন দশাটা দেখলে আপনারও খারাপ লাগবে! ফিরে এসে কেওঁটসহ বাজারের মধ্যে দিয়ে চলে আসুন রুদ্রপুর। আপনার ধারণা ছিল এখানে সব বাড়ি জ্বলে-পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। ওই ছেলেটার বাড়ির কিছু অংশ ভাঙা আর পোড়া দেখতে পাবেন। আপনার মতো আমার ও খারাপ লাগছে দাদা! ছোটবেলা থেকে এরকম দেখতে অভ্যস্থ নইতো ! এখনো আমার মতো এই অঞ্চলের বহু মানুষের ঘোর কাটেনি !!! দুঃস্বপ্ন এর মতোই সবাই এটাকে ভুলতে ব্যাস্ত। ফেস-বুকটা যে এমনভাবে একদম ধর্মের বুকে গিয়ে বিঁধবে কে জানতো! শুনেছিলাম ধর্মের সুড়সুড়িতে সবারই নাকি কাতুকুতু লাগে। আর এই সময়ে একটু বেশিই। ভয় ছিল, আমাদেরও লাগবে নাতো?? ছোঁয়াচে শুনেছি দাদা এটা। এখন বাদুড়িয়া-রুদ্রপুর ঘুরে আপনার কি মনে হলো?? কাতুকুতু কি সবার লেগেছে ?? যাগ্গে দাদা, এটা আমাদের ঘরের সমস্যা, আমরাই মেটাবো। আপনি পারলে বলে দেবেন, এগুলোতে সোশ্যাল মিডিয়াতে কাতুকুতু নাদেওয়াই ভালো। সংক্রামক তো আজ আপনি নেই , কাল আপনার কাতুকুতু লাগবে না, কে বলতে পারে !!
ও আপনাকে রাস্তাটা বলে দিই। রুদ্রপুর স্কুলের সামনে দিয়ে মগরা হয়ে মসলন্দপুর চলে আসুন। বরিশাল হোটেল এ বিরিয়ানি খেয়ে ট্রেন এ উঠে পড়ুন। আরে বলতে ভুলে গেলাম, বাদুড়িয়াতে মিষ্টি খাবেন না? "মিষ্টিমুখ" দোকানে চলে যান। আপনি অনেক মিষ্টি আগে কখনো চোখে দেখেননি নিশ্চিত। বাড়ির জন্য নিয়ে যান মিষ্টিমুখে, কারণ আবার কবে আসবেন ঠিক আছে।