অনুগল্প: নিপাট এক ভদ্রলোকের উদ্দেশ্যে রা মি জ আ ক্তা র ৫ মিনিটের মধ্যে বোর্ডিং শুরু হবে। দিল্লী এয়ারপোর্টে বসে আছি। এ...
অনুগল্প:
নিপাট এক ভদ্রলোকের উদ্দেশ্যে
রা মি জ আ ক্তা র
৫ মিনিটের মধ্যে বোর্ডিং শুরু হবে। দিল্লী এয়ারপোর্টে বসে আছি। একটা ট্রাইপড, ২ টো ডিএসএলআর ক্যামেরা, একটা স্টেডি ক্যাম আর কিছু জামাকাপড় মিলিয়ে ব্যাগটা বেশ ভারী হয়েছে।সত্যি বলতে এই অফারটা আমার পাওয়ার কথা নয়। দুমাস হলো জবটা পেয়েছি ন্যাশনাল জিওগ্রাফি চ্যানেলে। আমি আমার কিছু বানানো ডকুমেন্টরি ওদের পাঠিয়েছিলাম। ওদের ভালো লাগে, তারপর আমাকে অফার লেটার পাঠায় এসিস্ট্যান্ট ক্যামেরাম্যান এর পোস্টে। আমার তো তারপর ২-৩ দিন ঘুম হয়নি। তখনও যানতাম না, আমাকে আফগানিস্তান যেতে হবে। রিজিওনাল হেড আমাকে ডেকে বললো, শুরুতেই এত বড় দায়িত্ব পাওয়ার একটাই কারণ নাকি, আমার নাম। বললো নামের আগে "মোঃ" থাকলে ওই অঞ্চলে চলাফেরা করা খুব সুবিধাজনক। এদিকে পাসপোর্ট করাতে গিয়ে ছোট "মোঃ" কে টেনে বড় করে দিলো! আফগানিস্তানের বর্তমান যুদ্ধ পরবর্তী পরিস্থিতির ওপর একটা ৫ এপিসোডের সিরিজ হবে। একজন এসিস্ট্যান্ট চেয়েছিলাম, কেও রাজি হয়নি আসতে! অগত্যা নিজেকে নিয়ে ডকুমেন্টারি বানানোর নেশার ঘোরে বেরিয়ে পড়লাম। প্রথম বোর্ডিং আনউন্সমেন্ট হতেই মনের মধ্যে একটা ক্ষীণ দুরাশা তৈরী হলো। বোধহয় আর দেশের মাটিতে পা দেওয়া হলো না!
ইসলামাবাদ বিমানবন্দরে যখন নামলাম, তখন প্রায় সন্ধ্যে হবো হবো। বাইরে বেরিয়ে এদিক -ওদিকে তাকাতেই আমার নামের একটা বড় প্ল্যাকার্ড দেখতে পেলাম। যদিও "মোহাম্মদের" গুঁতোয় আসল নামটাই চাপা পড়ে গেছে! বছর আঠাশের ছেলেটাকে দেখে বুঝলাম, এই রহিমুল্লাহ। দিল্লীর অফিস থেকে আগেই এর সঙ্গে যোগাযোগ করে। ও এখানকার, মানে পেশোয়ারের একটা স্থানীয় নিউজ চ্যানেলের রিপোর্টার। আফগানিস্তান-পাকিস্তানের সীমান্ত এলাকা ওর নখদর্পনে। শুনেছি ও নাকি ওসামা বিন লাদেনের ইন্টারভিউ নিয়েছিল নিউজ চ্যানেলে জয়েন করবার ২ দিন পরেই। সেটা নিয়ে সারা বিশ্বে বেশ হইচৈ পড়েছিল। ছেলেটার মুখভর্তি দাড়ি, মাথায় টুপি, পরনে আলখাল্লা। কাছে যেতেই আসালামওলাইকুম বলে আমার দিকে দুহাত বাড়িয়ে দিলো। আমিও দুহাত বাড়িয়ে কোলাকুলি করলাম। ছেলেটার হাসির মধ্যে একটা অমলিন ভাব আছে, যা দেখলে প্রথম দর্শনেই ওকে খুব পরিচিত বলে মনে হবে। ও আমাকে মোহাম্মদ ভাই বলেই ডাকতে শুরু করলো। আমাকে দ্রুত পা চালাতে বলল, কারণ এখুনি ডিপো থেকে পেশোয়ারের বাসটা ছাড়বে। আমি বললাম কিছু খাওয়া দাওয়া করলে হতো না, মানে আমার বেশ ক্ষিদে পেয়েছে। ও ওর হাতের ব্যাগটা দেখিয়ে বললো, ওর আম্মিজান আমাদের দুজনের জন্যেই খাবার বানিয়ে দিয়েছে। মনে মনে একটা অদ্ভুত ভালোলাগা তৈরী হলো। দেশভাগের ৭০ বছর পর, এত ভাগাভাগির পরেও দুদেশের সাধারণ মানুষের বোধটা এখনও ভাগ হয়নি হয়তো! মোটা মোটা চাপাটি আর দুম্বার (উটের) মাংস। জীবনে অনেক মাংসই খেয়েছি। দুম্বার মাংস এই প্রথম। আর শেষে একটা পায়েস খেলাম, এত ভালো লেগে গেল যে রহিমুল্লাহকে বললাম বাড়ি ফিরবার পথে ওই পায়েসটা আবার খাবো। ও একগাল হেসে মাথা নেড়ে সায় দিল।
বাসটিতে তেমন ভিড় নেই। বেশকিছু মহিলা যাত্রীও আছে। সবারই বোরখা পরা। জানালা দিয়ে বাইরেটা দেখতে দেখতে চললাম। গাড়ি-ঘোড়া, দোকানপাটগুলোতে একটা প্রাচীনতার ছাপ আছে। একটা ধ্বংসস্তূপের দিকে আঙুল দেখিয়ে রহিমুল্লাহ বললো, এটা একটা মেয়েদের সরকারি স্কুল ছিল। গতবছর বিস্ফোরণে জঙ্গিরা স্কুলটা উড়িয়ে দেয়। প্রায় শতাধিক স্কুল পড়ুয়ার মৃত্যু হয়! নিউজে আমিও দেখছিলাম। কিন্তু এতজন মারা গেছে জানতাম না! ও বললো, তারপর থেকে মেয়েদের স্কুল গুলো প্রায় বন্ধই হয়ে গেছে! যত শহর থেকে দূরে সরে আসছি, ক্রমশঃ অন্ধকারটা বেশ গাঢ় আকার ধারন করছে। যখন পেশোয়ারে নামলাম তখন প্রায় রাত ৯ টা বাজে। রহিমুল্লাহ একটা লজে নিয়ে গিয়ে উঠলো। আশেপাশে খুব বড় হোটেল চোখে পড়লো না। ছোটখাটো লজ অনেক আছে। লজের মালিক প্রথমে আমাকে বেশ কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করলো আপাদমস্তক। রহিমুল্লাহ ওর সঙ্গে কি স্থানীয় ভাষায় কথা বললো। তারপর লোকটার দৃষ্টিভঙ্গিই পরিবর্তন হয়ে গেল। দোতলার একটা দু-বেড যুক্ত ঘর দিলো। রাতে দ্রুত ঘুমিয়ে গেলাম। পরদিন সকালে পাশের মসজিদের আযান শুনে ঘুম ভেঙে গেল। উঠে দেখি, রহিমুল্লাহ ফজরের নামাজ পড়ছে। সকালে লজেই ব্রেকফাস্ট করেই দুজনে বেরিয়ে পড়লাম।
রহিমুল্লাহ জানালো, এখান থেকে ভালো যানবাহন তেমন কিছু পাওয়া যাবে না। একটা ছোট টেম্পো জাতীয় গাড়িতে উঠলাম। এটা খাইবার পাস হয়ে আফগানিস্তান পৌঁছবে। রাস্তাটা দেখলে মনে হয় যেন পাহাড়ের বুক চিরে চলে গেছে। এই খাইবার পাস কত ইতিহাসেরই না সাক্ষী। রাস্তার দুপাশ দিয়েই শরণার্থীদের ভিড় দেখতে পাচ্ছি। এই ভিড় ক্রমশঃ বাড়ছে যতই আফগানিস্তানের সীমান্তের দিকে এগোচ্ছি। কিছু দূর আসবার পর টেম্পোটা থেমে গেল। রহিমুল্লাহ বললো ও আর এর পর যাবে না। এই অঞ্চলে তালিবানদের উৎপাত খুব বেশি।ভয় পায় গাড়ি নিয়ে আসতে। বাধ্য হয়ে হাঁটতে লাগলাম। কিছুটা আসবার পর একটা ঘোড়ার গাড়ি পেলাম, অনেকটা এক্কা গাড়ির মতো। কিছু মোটা বকশিসের লোভ দেখিয়ে ঘোড়ার গাড়িতে চেপে পড়লাম। সে এক অদ্ভুদ অনুভূতি, খাইবারপাসের রাস্তায় ঘোড়ার গাড়িতে! ঘোড়ার গাড়ির মালিক, মানে বছর ১৬-১৭ এর ছেলেটা কি একটা গুন-গুন করে গান গাচ্ছিলো। আমি ওকে জোরে গাওয়ার জন্যে অনুরোধ করলাম। ছেলেটা প্রথমে একটু লজ্জা পেল। তারপর গলা ছেড়ে গাইতে লাগলো। সেই দেহাতি গলা পাহাড়ের গায়ে প্রতিধ্বনিত হতে হতে চললো।
তোরখাম সীমান্তে এসে পৌঁছলাম সন্ধ্যে নাগাদ। পুলিশের সঙ্গে বেশকিছুক্ষন লড়তে হল প্রবেশ পাওয়ার জন্য। রহিমুল্লাহ না থাকলে সেটা কখনোই সম্ভব হতো না। কিছুটা পায়ে হেঁটে যেতেই দেখতে পেলাম নাসেরবাগ রিফিউজি ক্যাম্প। পাশেই একটা ধ্বংসস্তুপ দেখলাম। বাচ্চাদের স্কুল ছিল বলে মনেহল। হাজার হাজার মানুষ ত্রিপলের নিচে সংসার করছে এখানে। আজ রাতটা এখানেই কাটিয়ে দেব ঠিক করলাম। কাল থেকেই কাজ শুরু করব। একটা ত্রিপল টাঙ্গিয়ে ব্যাগটা রেখে আমি আর রহিমুল্লাহ সবে মাত্র হাত-পা এলিয়ে শুয়েছি। হঠাৎ গুলির আওয়াজ শুনতে পেলাম। সঙ্গে সঙ্গে শান্ত ক্যাম্পটা প্রচন্ড অশান্ত হয়ে উঠলো। ক্রমশঃ গুলির আওয়াজ চারিদিক থেকেই আসতে লাগলো। সবাই দিক বিদিক না দেখে ছুটতে শুরু করলো। আমিও কিছু না বুঝেই ছুটতে শুরু করলাম। কিছুটা যেতেই একটা ভাঙা পাঁচিলের পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। অন্ধকারে কিছু তেমন দেখতে পাচ্ছি না। আশপাশে রহিমুল্লাহকেও দেখছি না। সামনেই একটা আগুনের ফুলকির মতো কি একটা এসে পড়লো দূর থেকে। সঙ্গে সঙ্গেই বিকট শব্দে কান বন্ধ হয়ে গেল। কিছুক্ষন আমার কিছুই মনে নেই। সামনেই দেখলাম ক্যাম্পটা দাউদাউ করে জ্বলতে শুরু করলো। পাঁচিলটা পুরোটাই ভেঙে গেছে বিস্ফোরণে। ডান হাতটা প্রচন্ড যন্ত্রণা হচ্ছে। একটা চোখে দেখতেই পাচ্ছি না কিছু। দূরে শুনতে পেলাম বিকট প্লেনের শব্দ। হঠাৎ শব্দটা খুব কাছে আসতে লাগলো। কি করবো বুঝতে পারছি না। আচমকাই কে যেন আমার ডান হাতটা শক্ত করে চেপে ধরলো। মুখ ঘুরিয়ে দেখলাম একটা বছর ১২-১৩ এর মেয়ে। ওর মুখের দিকে তাকাতেই মনে পড়ে গেল আমার, এই মুখ আমি আগে কোথাও দেখেছি। সঙ্গে সঙ্গে ন্যাশনাল জিওগ্রাফির স্টিভ ম্যাকারীর সেই আলোড়ন ফেলা ছবিটা চোখের সামনে ভেসে উঠলো। সেই একই চোখ, যাতে দাউদাউ করে জ্বলছে আগুন !! মেয়েটি আরো শক্ত করে হাতটা চেপে ধরলো। ক্রমশঃ হাতটা ধরে রীতিমতো জোরে জোরে ঝাকুনি দিয়ে টানতে লাগলো। আমিও হাতটা সরিয়ে নেওয়ার প্রাণপন চেষ্টা করতে লাগলাম। ওওঁ টানছে আমিও টানছি। সজোরে আমিও একটা ঝাঁকুনি দিতেই দড়াম করে একটা শব্দ হলো। দেখলাম খাটের পাশে পড়ে আছি। মেরুদণ্ডে প্রচন্ড লেগেছে। আর সামনে খিলখিলিয়ে হেসে চলেছে আমার ছোট্ট বোন। ওর হাসি থামছেই না। প্রথমে তো আমার প্রচন্ড রাগ হলো, কিন্তু খানিক পরেই আমিও হেসে ফেললাম। ওর হাসি তখনও বন্ধ হয়নি। ও বললো তোর কি ঘুম রে ছোটদা? কখন থেকে ডেকে চলেছি। টেনে চোখ খুলে দিলাম, তাও একটা চোখ বন্ধ করে রাখলি। বেলুন ফাটালাম কানের কাছে, তাও উঠলি না! বাধ্য হয়ে খাট থেকে ফেলে দিলাম। আমি একটু রেগে গিয়ে বললাম খুব ভালো করেছো। এবার ব্রাশটা দে আমাকে। আর চা কর আসছি আমি মুখ ধুয়ে। ও তখনও থেকে থেকে কঁকিয়ে কঁকিয়ে হাসছে।
ব্রাশ করতে করতে স্বপ্নটা মনে করবার চেষ্টা করলাম। সব ঠিক-ঠাক মনে করতে পারছি না। কিন্তু এরকম একটা স্বপ্ন কেন দেখলাম বুঝতে পারছি না? হঠাৎ মনে পড়লো, কাল রাতে ইউটিউবে "দি সার্চ ফর দা আফগান গার্ল" দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে গেছিলাম। এখনো ল্যাপটপে খোলা ওটা। মুখ ধুয়ে ঘরে এসে ফেসবুক খুলতেই দেখলাম এক ভদ্রলোক আজ চলে যাচ্ছে নতুন ঠিকানায়! ব্যাগটার দিকে তাকাতেই পুরো ব্যাপারটা বুঝে গেলাম। ব্যাগের মধ্যে ডিএসএলআরটা ওই ভদ্রলোকেরই। আর স্টিভ ম্যাকারীর সঙ্গে আমার পরিচয় ওই ভদ্রলোকের হাত ধরেই। ওই ভদ্রলোকটার জন্যেই ক্যামেরার পিছনে থাকার হাতেখড়ি, সামনে আসার সাহস হয় না। চেয়ারে বসে ভাবতে ভাবতে পুরো ব্যাপারটাই খুব সামঞ্জস্যপূর্ণ মনেহল। হাসিও পেল খুব, একেবারে "ন্যাশনাল জিওগ্রাফি!! এবার ভদ্রলোককে বলব, যে নাম না বদলেও পছন্দমতো কাজ পাওয়া যায়, সে স্বপ্নেই হোক! যদিও ভালোও লাগলো পুরো স্বপ্নের উৎস খুঁজে পেয়ে। বোনটা চা দিতে এল, তখনো হাসছে ও। হঠাৎ ওর মুখের দিকে তাঁকিয়ে আমার সারা গাঁয়ে শিহরণ খেলে গেল। স্বপ্নের ওই মেয়েটার চোখ আমি আরো কোথাও দেখেছি। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো আবার। হাত-পা অবশ হয়ে গেল আমার। গত মাসে যখন গ্রামের লোকেরা রবিন কাকার বাড়িটা জ্বালিয়ে দিয়েছিল দাঙ্গার সময়। আমার ডান হাতটা ঠিক ওমনিভাবেই শক্ত করে ধরে রেখেছিল আমার ছোট বোন। মুখ ঘুরিয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে সেই একই চোখ দেখছিলাম। এখন আর দুটো চোখের মধ্যে কোনো পার্থক্য করতে পারছি না!!
(Research Scholar, IIT Guwahati)