জেলার কথা: প্রাচীন ঐতিহ্যের মুর্শিদাবাদ আজও পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় পেলনা! ■ ই ম রা ন হো সে ন ■ ● ইংরাজী, এম. এ., কলকাতা ...
■ ই ম রা ন হো সে ন ■
● ইংরাজী, এম. এ., কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ●
ছোটবেলায় যখন দেখতাম পাড়ায় কারো বাড়ি হলেই মুর্শিদাবাদের কমবয়সী রাজমিস্ত্রী এসেছে, তখন ভাবতাম এই মুর্শিদাবাদের যুবকরা কি পড়াশোনা করে না! তখনও জানতাম না কোন দিকে মুর্শিদাবাদ আর কি তার আর্থ-সামাজিক অবস্থা। তবে সিরাজুদ্দৌলা পড়ার সময় জানতে পেরেছিলাম যে এই মুর্শিদাবাদই একদিন বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার রাজধানী ছিল।
পরে জানতে পারি ওখানে নাকি বেশীরভাগ মুসলিমদের বাস। আর মুসলিম মানেই তো ভাবা হয়, পড়াশোনার উল্টো মেরুতে অবস্থান করে। এ কথা কিছুটা হলেও সত্যি। কিন্তু যারা এই উল্টো মেরু থেকে মূলস্রোতে আসতে চায় তারা যখন অসহযোগিতা, বৈষম্য ও বঞ্চনার স্বীকার হয়, তখন এই অভিযোগ নিতান্তই শুকনো আর অখাদ্য মনে হয়।
স্বাধীনতার সত্তর বছরেও ইউনিভার্সিটি পাইনা মুর্শিদাবাদ! অতীত ঐতিহ্য নিয়ে প্রায় আশি লক্ষ জনসংখ্যার মুর্শিদাবাদ তবুও ইউনিভার্সিটি পাইনা! এই বাংলার অতীতের অহংকার 'রাজধানী' মুর্শিদাবাদ। মুখ্যমন্ত্রী ঝাড়গ্রাম সহ আরও চারটে ইউনিভার্সিটির ঘোষনা করতে পারে। কিন্ত মুর্শিদাবাদের পাতে একটিও পড়ে না!
আমরা যারা কলকাতার শহুরে ছেলে আমাদের কলেজ বা ইউনিভার্সিটি নাকের ডগায়, তাই ওই বিড়ি শিল্পের মুর্শিদাবাদে ইউনিভার্সিটি না থাকার অভিশাপ বুঝে উঠতে পারিনা! বিড়ি শিল্পের পরিবার থেকে উঠা আসা ছাত্রদের কল্যাণী বা গৌড়বঙ্গ ইউনিভার্সিটিতে আসা-যাওয়ার খরচ ও সময় আঁচ করতে পারিনা!
একজন ছাত্র বা ছাত্রীর উচ্চ শিক্ষার জন্য যদি ইউনিভার্সিটি আসতে হয় তাহলে তার প্রতিদিনের খরচ কমপক্ষে একশ টাকা এবং সারাটা দিন বাসেই বসে থাকতে হয়। যে ছেলের পরিবার বিড়ি বেঁধে বা চাষবাস করে দৈনিক খাবার জোগাড় করতে হিমশিম খায়, তার ছেলে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হবে এ একপ্রকার অলীক কল্পনা ছাড়া কিছু নয়! তাই সহজেই তারা পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে দিয়ে রাজমিস্ত্রি হওয়াটাই পছন্দ করে! যে ছেলেটা মেধা নিয়ে উচ্চ শিক্ষা লাভ করতে মনস্থির করে তার কাছে উচ্চশিক্ষা দিবাস্বপ্ন হয়ে থেকে যায়!
শ্রদ্ধেয় রাষ্ট্রপতি প্রণব বাবু যে কত ইউনিভার্সিটির দ্বার উদ্ঘাটন করেছেন, কত ইউনিভার্সিটিতে বক্তব্য দিয়েছেন, আর কত ইউনিভার্সিটি থেকে ডিলিট পেয়েছেন, তার হিসাব হয়ত তাঁর নিজেরও মনে নেই। কলকাতা ইউনিভার্সিটির বার্ষিক অনুষ্ঠানে তাঁর আসাটা প্রায় সূর্য উঠার মতই নিশ্চিত। কিন্তু প্রণব বাবুর মনে পড়ে না মুর্শিদাবাদের কথা! সেই সব বিড়ি শ্রমিকদের কথা, যাদের ভোটে উনি দেশের সর্ব্বোচ্চ সাংবিধানিক পদের অধিকারী হয়ে ছিলেন। অবশ্য মনে পড়বেই বা কেন, প্রণববাবুর ছেলে-মেয়ে তো আর মুর্শিদাবাদে থেকে উচ্চ শিক্ষা লাভ করেনি!
আর আমরা যারা যাদবপুরের 'হোক কলরব' বা স্কটিশ চার্চ কলেজের ইউনিফর্ম কোডের আন্দোলন দেখে অভ্যস্ত, ভুলে যায় মুর্শিদাবাদকে, ভুলে যায় ওদের সমস্যা গুলোকে। কলকাতার স্বঘোষিত বুদ্ধিজীবিদের মোমবাতি মিছিল তো এলিট শ্রেণীর মদ্যপ ছাত্র আবেশের মৃত্যুতেই সীমাবদ্ধ! এবিপি আনন্দে সুমনের টক-শো মুসলিম সমাজের এক শতাংশের কম ঘটে যাওয়া তালাক নিয়ে হয়। কিন্তু মুসলিম অধ্যুষিত মুর্শিদাবাদে ইউনিভার্সিটি না থাকা নিয়ে আলোচনা সেখানে স্থান পাইনা।
আমরা ইতিহাসের পাতায় মুর্শিদাবাদ কে পড়েছি। মিরজাফর কে বিশ্বাসঘাতক হিসাবে চিনেছি। ভবিষ্যতে আবারও লেখা হবে মুর্শিদাবাদের ইতিহাস। যেখানে থাকবে এই বঞ্চনা, থাকবে মোদের শ্রদ্ধেয় রাষ্ট্রপতির ব্যর্থতা। আর পরবর্তী প্রজন্ম সেই ইতিহাস পড়বে। তখন মনে হবে ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না....।
(মতামত একান্ত নিজস্ব)
(মতামত একান্ত নিজস্ব)
COMMENTS