ছোটোগল্প: সম্পর্ক ■ আ বু জু না ই দ ■ সোনাপুর বাসস্ট্যান্ডে যাত্রী প্রতিক্ষালয়ের পাশে গোছানো-গাছানো চায়ের স্টল। বি.এ. পাশ ...
■ আ বু জু না ই দ ■
সোনাপুর বাসস্ট্যান্ডে যাত্রী প্রতিক্ষালয়ের পাশে গোছানো-গাছানো চায়ের স্টল। বি.এ. পাশ করার পর সাইফুল চাকরির জন্যে হন্যে হয়ে ঘুরে কোন কিছু না পেয়ে পি. ডব্লিউ. ডি. -র জায়গায় একটা চায়ের দোকান খোলে। তখন জায়গাটা এত জমজমাট ছিল না। এখন সারাদিনে বিশ-পঞ্চাশ লোক পাওয়া যায়। নয় নয় করে সাইফুলের চায়ের দোকানের বয়স বছর কুড়ি হল। এখন অনেক দোকান পাট হয়েছে। বেশ কয়েকটি চায়ের দোকানও হয়েছে। কিন্তু সাইফুলের চায়ের সুনাম অনেক দুর পর্যন্ত ছড়িয়ে গেছে।
প্রতিদিনের মত আজও সাইফুল বিকালে দোকানটা খুলে বাসেছে।
-ভাই পাউরুটি হবে?
-হবে। বলে সাইফুল দেখে মলিন মুখে একজন পুরুষ ও একজন মহিলা দাঁড়িয়ে।
সাইফুল তাদের বসতে বললেন পাশে রাখা বেঞ্চে।
-কি দেব ভাই?
-দুটো রুটি, দুটো লাড্ডু দেন।
সাইফুল রুটি, লাড্ডু আর পানির পাত্রটা এগিয়ে দেয়।
মহিলাটি পুরুষটির উদ্দেশ্যে বলে, 'তোমার বললাম দুটো ভাত খেয়ে নিতে, তুমি তো খেতেই চাইলে না।'
পুরুষটি বলেন, 'তুমি তো বলছ, একবারও কি তোমার ভাই-ভাবিরা জিজ্ঞাসা করেছিল আমরা কখন বেরিয়েছি, কি খেয়েছি না খেয়েছি?'
-কি বলব বল! আগে যখন ভাইদের এত অর্থ-প্রতিপত্তি ছিল না তখন তাদের আন্তরিকতা ছিল, যা ভুলবার না। আজ আর তা দেখা যাচ্ছে না।'
-তোমার ভাই বলল 'ওমরাহ' করতে যাবেন, তাই ওই টাকাটুকু ছাড়া আর ওনার কাছে টাকা নেই। আচ্ছা সালমা তোমার ভাই তো হজ্জ করে এলেন দুবছর আগে। ওমরাহ না করে ওই টাকাটা বোনের চিকিৎসার জন্যে দিলে কি পুণ্য হত না?
-ছাড় ওসব কথা। আমরা যে পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, আল্লাহ আমার জন্যে যেটা কল্যাণকর মনে করবেন তাই হবে। ওনিয়ে আর দুঃখ করনা।
সাইফুল হাতে কাজ করলেও ঐ পুরুষ আর মহিলাটির কথার দিকে কান ছিল।
-কি বা করার আছে? এদিকে যা ছিল টেষ্ট করতে গিয়ে শেষ হয়ে গেছে। শুধুমাত্র অপারেশানের খরচই পয়ত্রিশ হাজার টাকা বলেছেন। আবার তাড়াতাড়ি না করলে অন্য সমস্যা দাঁড়াতে পরে। চলো দেখি বাড়ি গিয়ে কি করা যায়। ভেবেছিলাম বড় বিপদের সময় রক্তের সম্পর্কের মানুষগুলোকেই আগে কাছে পাওয়া যায়। আজ আর তা খাঁটছে কই! এখন সম্পর্ক হচ্ছে যাদের অর্থ আছে তাদের মধ্যে।
সাইফুল ওদের এভাবেই বসে গল্প করতে দেখে জিজ্ঞাসা করে- ভাই চা দেব?
-না। পুরুষ মানুষটি বলে।
-চলো সেই সকালে বেরিয়েছি। ছেলে-মেয়ে দুটো কি করছে কে জানে! চলো।
পুরুষ মানুষটি কত হয়েছে জানতে চাইলে সাইফুল বলে- আপনাদের কুড়ি টাকা হয়েছে।
সাইফুলের হাতে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট দিলে দামটা কেটে নিয়ে বাকি পয়সা ফেরৎ দিতে জিজ্ঞাসা করেন- যদি কছু মনে না করেন একটা কথা জানবার ছিল?
-বলুন। পুরুষ মানুষটি বলেন।
-আপনাদের বাড়ি কোথায়?
-বেগমপুর উত্তর পাড়া।
-বেগমপুর? তাহলে সামীম মাস্টাকে চেনেন?
-ওনাকে কে না চেনেনা? কে হন আপনার?
-ফুফাতো ভাই।
-আমি ওনার ছেলেদের টিউশনি পড়াই। উনি খুব খুব ভালো মানুষ। দায়-বিদায় অনেক সাহায্য করেন। ওনার ওখানে গেলে আমার বাড়িতে আসবেন ভাই। ওনাকে বলবেন নিযামের বাড়িতে যাব, উনি বলে দেবেন। আসি ভাই দোয়া করবেন।
-ফী আমানিল্লা।
একটা অটো আসতে দেখে নিযাম ও সালমা এগিয়ে যায়।
সাইফুলের মনের মধ্যে যেন কেমন একটা ঝড় বয়ে গেল। ওদের সমস্ত আলোচনাই সে শুনেছে। যত সময় যাচ্ছে সমাজটা যেন বড্ড আমিত্বের গোন্ডীতে আবদ্ধ হয়ে পড়ছে। রক্তের সম্পর্কের মানুষগুলো অর্থিক সমকক্ষ মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরী করছে। তৈরী হচ্ছে স্ট্যাটাস নামক অদৃশ্য প্রাচীর। সকাল সন্ধ্যায় কত মানুষ আসে সাইফুলের টি-স্টলে, কত আলোচনা হয়। সাইফুল প্রতিদিন যেন পৃথিবীকে বড্ড বেশী পাল্টে যেতে দেখছে।
● ● ●
দোকান বন্ধ করে সাইফুলের বাড়ি ফিরতে প্রায়ই সাড়ে দশটা এগারোটা বেজে যায়। তখনও সাইফুলের ছেলে-মেয়েরা বই পড়ে। স্ত্রী হালিমা সেলাই মেশিনে ভোডা প্যান্ট তৈরী করে। এ থেকে প্রায় সপ্তাহে ছয়-সাতশো টাকা আসে। ছেলে-মেয়েদের টিউশানি খরচটা এখান থেকে ওঠে।
ওরা সকলে একসঙ্গেই খাওয়া দাওয়া করে। ছেলে-মেয়েরা যে যার বিছানায় চলে গেলে সাইফুল হালিমা বিছানায় যায়।
অন্যান্য দিন বিছানায় শুতে শুতে ঘুমিয়ে পড়ে সে। আজ ঘুম আসছে না, শুধু এ পাশ ওপাশ করছে। হালিমা তখনও ঘুমাইনি।
হালিমা তাকে জিজ্ঞাসা করে- 'কি হল বল তো আজ তোমার?'
-কেন?
-সেই কখন থেকে এপাশ ওপাশ করছ কোন অসুবিধা হচ্ছে তোমার?
-না, মানে।
-কি হল বল না আমার।
- আমি নিযাম বলে এক ব্যক্তির অসহায় মুখটার কথা কিছুতেই ভুলতে পারছিনা।
-কেন। কি হয়েছে খুলে বল না!
সাইফুল সমস্ত ঘটনা তার স্ত্রীকে খুলে বলল।
-সবাই তো শুনলাম। কিন্তু তুমি কিভাবে নিযামের পাশে দাঁড়াবে?
-আমি বলছিলাম হজ্জের নিয়তে জমানো টাকাটা যদি আমি নিযামের বৌয়ের অপারেশানে দিই তাহলে কেমন হয়? আল্লাহ তো আমার আন্তরিক ইচ্ছাটা দেখবেন। তুমি কি বলছ?
-আমি কি বলব বলত? তুমি একটু একটু করেতশ হজ্জের নিয়তে জমিয়েছ, তাই তো ভাবছি।
-দেখ হালিমা এখন হজ্জের খরচ তো মিনিমাম দেড় থেকে দু লাখ টাকা, ঐ টাকা জোগাড় করতে করতে যদি আল্লাহ তুলে নেন! আমার মনে হয় আল্লাহ চাইলে যেকোনো অছিলায় আমার হজ্জ করিয়ে নেবেন।
-তা অবশ্য ঠিই। তবুও তোমার ফুফাতো ভাই সামিম মাস্টারের কাছে খোঁজখবর নিয়ো।
-নেব। ঘুমাও ফজরে আমার ঘুম ভাঙবে তো?
-হ্যাঁ, ঘুমানোর চেষ্টা কর।
প্রতিদিনের মত আজও সাইফুল বিকালে দোকানটা খুলে বাসেছে।
-ভাই পাউরুটি হবে?
-হবে। বলে সাইফুল দেখে মলিন মুখে একজন পুরুষ ও একজন মহিলা দাঁড়িয়ে।
সাইফুল তাদের বসতে বললেন পাশে রাখা বেঞ্চে।
-কি দেব ভাই?
-দুটো রুটি, দুটো লাড্ডু দেন।
সাইফুল রুটি, লাড্ডু আর পানির পাত্রটা এগিয়ে দেয়।
মহিলাটি পুরুষটির উদ্দেশ্যে বলে, 'তোমার বললাম দুটো ভাত খেয়ে নিতে, তুমি তো খেতেই চাইলে না।'
পুরুষটি বলেন, 'তুমি তো বলছ, একবারও কি তোমার ভাই-ভাবিরা জিজ্ঞাসা করেছিল আমরা কখন বেরিয়েছি, কি খেয়েছি না খেয়েছি?'
-কি বলব বল! আগে যখন ভাইদের এত অর্থ-প্রতিপত্তি ছিল না তখন তাদের আন্তরিকতা ছিল, যা ভুলবার না। আজ আর তা দেখা যাচ্ছে না।'
-তোমার ভাই বলল 'ওমরাহ' করতে যাবেন, তাই ওই টাকাটুকু ছাড়া আর ওনার কাছে টাকা নেই। আচ্ছা সালমা তোমার ভাই তো হজ্জ করে এলেন দুবছর আগে। ওমরাহ না করে ওই টাকাটা বোনের চিকিৎসার জন্যে দিলে কি পুণ্য হত না?
-ছাড় ওসব কথা। আমরা যে পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, আল্লাহ আমার জন্যে যেটা কল্যাণকর মনে করবেন তাই হবে। ওনিয়ে আর দুঃখ করনা।
সাইফুল হাতে কাজ করলেও ঐ পুরুষ আর মহিলাটির কথার দিকে কান ছিল।
-কি বা করার আছে? এদিকে যা ছিল টেষ্ট করতে গিয়ে শেষ হয়ে গেছে। শুধুমাত্র অপারেশানের খরচই পয়ত্রিশ হাজার টাকা বলেছেন। আবার তাড়াতাড়ি না করলে অন্য সমস্যা দাঁড়াতে পরে। চলো দেখি বাড়ি গিয়ে কি করা যায়। ভেবেছিলাম বড় বিপদের সময় রক্তের সম্পর্কের মানুষগুলোকেই আগে কাছে পাওয়া যায়। আজ আর তা খাঁটছে কই! এখন সম্পর্ক হচ্ছে যাদের অর্থ আছে তাদের মধ্যে।
সাইফুল ওদের এভাবেই বসে গল্প করতে দেখে জিজ্ঞাসা করে- ভাই চা দেব?
-না। পুরুষ মানুষটি বলে।
-চলো সেই সকালে বেরিয়েছি। ছেলে-মেয়ে দুটো কি করছে কে জানে! চলো।
পুরুষ মানুষটি কত হয়েছে জানতে চাইলে সাইফুল বলে- আপনাদের কুড়ি টাকা হয়েছে।
সাইফুলের হাতে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট দিলে দামটা কেটে নিয়ে বাকি পয়সা ফেরৎ দিতে জিজ্ঞাসা করেন- যদি কছু মনে না করেন একটা কথা জানবার ছিল?
-বলুন। পুরুষ মানুষটি বলেন।
-আপনাদের বাড়ি কোথায়?
-বেগমপুর উত্তর পাড়া।
-বেগমপুর? তাহলে সামীম মাস্টাকে চেনেন?
-ওনাকে কে না চেনেনা? কে হন আপনার?
-ফুফাতো ভাই।
-আমি ওনার ছেলেদের টিউশনি পড়াই। উনি খুব খুব ভালো মানুষ। দায়-বিদায় অনেক সাহায্য করেন। ওনার ওখানে গেলে আমার বাড়িতে আসবেন ভাই। ওনাকে বলবেন নিযামের বাড়িতে যাব, উনি বলে দেবেন। আসি ভাই দোয়া করবেন।
-ফী আমানিল্লা।
একটা অটো আসতে দেখে নিযাম ও সালমা এগিয়ে যায়।
সাইফুলের মনের মধ্যে যেন কেমন একটা ঝড় বয়ে গেল। ওদের সমস্ত আলোচনাই সে শুনেছে। যত সময় যাচ্ছে সমাজটা যেন বড্ড আমিত্বের গোন্ডীতে আবদ্ধ হয়ে পড়ছে। রক্তের সম্পর্কের মানুষগুলো অর্থিক সমকক্ষ মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরী করছে। তৈরী হচ্ছে স্ট্যাটাস নামক অদৃশ্য প্রাচীর। সকাল সন্ধ্যায় কত মানুষ আসে সাইফুলের টি-স্টলে, কত আলোচনা হয়। সাইফুল প্রতিদিন যেন পৃথিবীকে বড্ড বেশী পাল্টে যেতে দেখছে।
● ● ●
দোকান বন্ধ করে সাইফুলের বাড়ি ফিরতে প্রায়ই সাড়ে দশটা এগারোটা বেজে যায়। তখনও সাইফুলের ছেলে-মেয়েরা বই পড়ে। স্ত্রী হালিমা সেলাই মেশিনে ভোডা প্যান্ট তৈরী করে। এ থেকে প্রায় সপ্তাহে ছয়-সাতশো টাকা আসে। ছেলে-মেয়েদের টিউশানি খরচটা এখান থেকে ওঠে।
ওরা সকলে একসঙ্গেই খাওয়া দাওয়া করে। ছেলে-মেয়েরা যে যার বিছানায় চলে গেলে সাইফুল হালিমা বিছানায় যায়।
অন্যান্য দিন বিছানায় শুতে শুতে ঘুমিয়ে পড়ে সে। আজ ঘুম আসছে না, শুধু এ পাশ ওপাশ করছে। হালিমা তখনও ঘুমাইনি।
হালিমা তাকে জিজ্ঞাসা করে- 'কি হল বল তো আজ তোমার?'
-কেন?
-সেই কখন থেকে এপাশ ওপাশ করছ কোন অসুবিধা হচ্ছে তোমার?
-না, মানে।
-কি হল বল না আমার।
- আমি নিযাম বলে এক ব্যক্তির অসহায় মুখটার কথা কিছুতেই ভুলতে পারছিনা।
-কেন। কি হয়েছে খুলে বল না!
সাইফুল সমস্ত ঘটনা তার স্ত্রীকে খুলে বলল।
-সবাই তো শুনলাম। কিন্তু তুমি কিভাবে নিযামের পাশে দাঁড়াবে?
-আমি বলছিলাম হজ্জের নিয়তে জমানো টাকাটা যদি আমি নিযামের বৌয়ের অপারেশানে দিই তাহলে কেমন হয়? আল্লাহ তো আমার আন্তরিক ইচ্ছাটা দেখবেন। তুমি কি বলছ?
-আমি কি বলব বলত? তুমি একটু একটু করেতশ হজ্জের নিয়তে জমিয়েছ, তাই তো ভাবছি।
-দেখ হালিমা এখন হজ্জের খরচ তো মিনিমাম দেড় থেকে দু লাখ টাকা, ঐ টাকা জোগাড় করতে করতে যদি আল্লাহ তুলে নেন! আমার মনে হয় আল্লাহ চাইলে যেকোনো অছিলায় আমার হজ্জ করিয়ে নেবেন।
-তা অবশ্য ঠিই। তবুও তোমার ফুফাতো ভাই সামিম মাস্টারের কাছে খোঁজখবর নিয়ো।
-নেব। ঘুমাও ফজরে আমার ঘুম ভাঙবে তো?
-হ্যাঁ, ঘুমানোর চেষ্টা কর।
সকলে একটু তাড়াতাড়ি দোকান থেকে ফিরে ব্যাঙ্ক থেকে ত্রিশ হাজার টাকা তুলে নিয়ে বেগমপুরের উদ্দেশ্যে সাইফুল বেরিয়ে পড়ে। প্রায় দুপুর বারোটা নাগাদ নিযামের বাড়িতে পৌঁছায়।
নিযাম বারান্দায় বসে তরকারি কুটছিল আর ওর বৌ রান্নাঘরে রান্না করছিল।
-আসসালামু আলাইকুম, বলে সাইফুল ছালাম দিল।
মুখটা উপরে তুলতে তুলতে নাযিম ছালামের উত্তর দিয়ে দেখল গতকাল সোনাপুর বাসস্টপের চায়ের দোকাদার।
-ভালো আছেন ভাই। বলে বারান্দায় একটা চেয়ার পেতে দিলেন।
-বাড়ির থেকে না মাস্টার সাহেবের বাড়ি থেকে?
-বাড়ি থেকে। আপনার কাছেই এলাম।
-আমার কাছে?
-হ্যাঁ, আপনার সাথে আমার একটু দরকার।
-বলুন।
-যদি কিছু না মনে করেন তো একটা কথা জিজ্ঞাসা করতাম।
-এত সঙ্কোচ করার কি আছে? আপনি কি জানতে চান বলুন।
-আপনার ওয়াইফের কি অপারেশন করাতে হব?
-ওভারিয়ান টিউমার। প্রায় দু বছর ধরে ভুগছে। প্রথমে তো অনেক হসপিটাল নার্সিং হোম করে অনেক ডক্তার দেখিয়েও কোন রোগ ধরা পড়ছিল না। আর.জি.কর. হসপিটালের ডাক্তাররা শেষমেশ বলেদিল, আপনার স্ত্রীর কোনো রোগ নেই, একজন নিউরোসাইক্রিয়াটিস্ট দেখিয়েনিন। তাই করলাম তাতেও কিছু হল না। পেটে ব্যথা করত গা গোলাতো। কোনকিছুর গন্ধ নিতেই পারত না। এখান-সেখান, এ ডাক্তার, কয়েকবার আল্টাসনোগ্রাফী, ইন্ডোসকপি করেও কোনো রোগ পাওয়া যাচ্ছিলনা। প্রায় দুবছর ধরে ছোটাছুটি করেছি। আমি টিউশানি করতাম। এখান সেখান দৌড়াদৌড়ি করতে করতে টিউশানি বাজারে আমি আর টিকতে পারিনি। এদিকে আমাদের এক হাতুড়ে ডাক্তারের পরামর্শ করলে উনি বললেন সিমটম যা তাতে ওভারিয়ান প্রবলেম বলে মনে হচ্ছে। তারপর আবার আল্টাসনোগ্রাফীতে ধরা পড়ল পেটের একটু গভীরে টিউমার রয়েছে। যা এদিকে কথা বলতে বলতে ভুলেই গেলাম! বসুন।
বলে নিযাম উঠে যায়। রান্নাঘর থেকে কিছুটা মুড়ি আর পানি সাইফুলের সামনে চৌকিতে রাখে।
-এসব আবার কি দরকার ছিল! আপনি বসুন আপনার কথা শুনতে খুব ইচ্ছে করছে। আপনার ছেলে-মেয়ে কয়জন?
-একটা ছেলে আর একটা মেয়ে। ছেলেটার বয়স বছর বারো আর মেয়েটার দশে পড়ল।
-এখন তো টিউশানি নেই, তবে চলে কি করে?
-একেবারে নেই তা না, কিছু স্পেশাল আছে, আর মাঠে বিঘা খানেক জমি আছে এদিক সেদিক করে চলে যায়।
-এখন অপারেশনের খরচ কেমন কি শুনেছেন?
-মোটামুটি একটা হিসাব ডাক্তারবাবু দিয়েছেন। সবকিছু নর্মাল থাকলে হাজার ত্রিশ-পঁয়ত্রিশের মধ্যে হয়ে যাবে।
-টাকার ব্যবস্থা করেছেন?
-চেষ্টা করছি। আচ্ছা এত সব খরব আপনি নিচ্ছেন কেন, বুঝতে পারছিনা।
-আমি যদি আপনার একজন ভাইয়ের মত এই বিপদে আপনার পাশে দাঁড়ায়!
নিযাম চুপ থাকে। অবাক হয়ে সাইফুলের দিকে তাকিয়ে থাকে।
সাইফুল তার ব্যাগ থেকে দুহাজার আর পাঁচশো টাকার নোট মিলিয়ে ত্রিশ হাজার টাকা এগিয়ে দেয় নিযামের দিকে,
-নিন এতে ত্রিশ হাজার টাকা আছে একটু গুনে নেবেন।
নিযামের দুচোখের কোনা থেকে পানি গড়িয়ে পড়ে। অস্রু মুছে নিযাম স্ত্রীকে ডাকে,
-সালমা এদিকে এসোতো, দেখ না ভাই সাহেব কি বলছেন।
-আমি সব শুনেছি।
-হ্যাঁ বোন, গতকাল তোমাদের কথা গুলো আমার কানে আসার পর থেকে সারারাত আমি ঘুমাতে পারিনি। আমার হজ্জের নিয়তে রাখা কিছু টাকা যদি আমার কোন বোনের চিকিৎসায় খরচ হয় তবে আমার মনে হয় আমার পূর্ণ কোন অংশে কম হবে না। দয়াকরে এটা গ্রহন করুন।
নিযাম হাত বাড়িয়ে টাকাটা নিল, দুচোখের পানি আটকাতে পারল না। সেই সঙ্গে সালমারও চোখে পানি এসে যায়।
-আমি এবার উঠব নিযাম সাহেব। দয়াকরে অপারেশনের তারিখটা জানাবেন।
সালমা এবার আর চুপ থাকতে পারল না। সে বললো, ভাই বোনের এ বিপদে পাশে দাঁড়াবে আর ভরদুপুরে না খেয়ে চলে যাবে এটা কখনো হয়?
-না বোন, আজ না। সামিমভাইকে বলা আছে। ভাবি রান্না করে রাখবে। না গেলে রাগ করবেন। আমি কথা দিচ্ছ তুমি সুস্থ্য হয়ে উঠলে সপরিবারে আমরা আসব।
-কথা দিচ্ছেন কিন্তু। সালমা বলে।
নিযাম বলে, আপনি যখন আজ এখানে খাবেন না আর আপনাকে বেশী জোর করব না। অপারেশানের দিনে আপনাকে থাকতে হবে, আমি আগেভাগই আপনাকে জানাব।
-ঠিক আছে ঐ কথাই থাকল। দোআ করবেন।
-ফী আমানিল্লাহ।
সালমা-নিযাম সাইফুলের চলে যাওয়া বাইকের ধোঁয়ার দিকে উদাসভাবে তাকিয়ে ভাবতে থাকে এখনো মানুষ মানুষের কথা ভাবা ছেড়ে দেয়নি, তা না হলে রাত না পোহাতে এমন মানুষকে আল্লাহ কেন পাঠাবেন!
নিযাম বারান্দায় বসে তরকারি কুটছিল আর ওর বৌ রান্নাঘরে রান্না করছিল।
-আসসালামু আলাইকুম, বলে সাইফুল ছালাম দিল।
মুখটা উপরে তুলতে তুলতে নাযিম ছালামের উত্তর দিয়ে দেখল গতকাল সোনাপুর বাসস্টপের চায়ের দোকাদার।
-ভালো আছেন ভাই। বলে বারান্দায় একটা চেয়ার পেতে দিলেন।
-বাড়ির থেকে না মাস্টার সাহেবের বাড়ি থেকে?
-বাড়ি থেকে। আপনার কাছেই এলাম।
-আমার কাছে?
-হ্যাঁ, আপনার সাথে আমার একটু দরকার।
-বলুন।
-যদি কিছু না মনে করেন তো একটা কথা জিজ্ঞাসা করতাম।
-এত সঙ্কোচ করার কি আছে? আপনি কি জানতে চান বলুন।
-আপনার ওয়াইফের কি অপারেশন করাতে হব?
-ওভারিয়ান টিউমার। প্রায় দু বছর ধরে ভুগছে। প্রথমে তো অনেক হসপিটাল নার্সিং হোম করে অনেক ডক্তার দেখিয়েও কোন রোগ ধরা পড়ছিল না। আর.জি.কর. হসপিটালের ডাক্তাররা শেষমেশ বলেদিল, আপনার স্ত্রীর কোনো রোগ নেই, একজন নিউরোসাইক্রিয়াটিস্ট দেখিয়েনিন। তাই করলাম তাতেও কিছু হল না। পেটে ব্যথা করত গা গোলাতো। কোনকিছুর গন্ধ নিতেই পারত না। এখান-সেখান, এ ডাক্তার, কয়েকবার আল্টাসনোগ্রাফী, ইন্ডোসকপি করেও কোনো রোগ পাওয়া যাচ্ছিলনা। প্রায় দুবছর ধরে ছোটাছুটি করেছি। আমি টিউশানি করতাম। এখান সেখান দৌড়াদৌড়ি করতে করতে টিউশানি বাজারে আমি আর টিকতে পারিনি। এদিকে আমাদের এক হাতুড়ে ডাক্তারের পরামর্শ করলে উনি বললেন সিমটম যা তাতে ওভারিয়ান প্রবলেম বলে মনে হচ্ছে। তারপর আবার আল্টাসনোগ্রাফীতে ধরা পড়ল পেটের একটু গভীরে টিউমার রয়েছে। যা এদিকে কথা বলতে বলতে ভুলেই গেলাম! বসুন।
বলে নিযাম উঠে যায়। রান্নাঘর থেকে কিছুটা মুড়ি আর পানি সাইফুলের সামনে চৌকিতে রাখে।
-এসব আবার কি দরকার ছিল! আপনি বসুন আপনার কথা শুনতে খুব ইচ্ছে করছে। আপনার ছেলে-মেয়ে কয়জন?
-একটা ছেলে আর একটা মেয়ে। ছেলেটার বয়স বছর বারো আর মেয়েটার দশে পড়ল।
-এখন তো টিউশানি নেই, তবে চলে কি করে?
-একেবারে নেই তা না, কিছু স্পেশাল আছে, আর মাঠে বিঘা খানেক জমি আছে এদিক সেদিক করে চলে যায়।
-এখন অপারেশনের খরচ কেমন কি শুনেছেন?
-মোটামুটি একটা হিসাব ডাক্তারবাবু দিয়েছেন। সবকিছু নর্মাল থাকলে হাজার ত্রিশ-পঁয়ত্রিশের মধ্যে হয়ে যাবে।
-টাকার ব্যবস্থা করেছেন?
-চেষ্টা করছি। আচ্ছা এত সব খরব আপনি নিচ্ছেন কেন, বুঝতে পারছিনা।
-আমি যদি আপনার একজন ভাইয়ের মত এই বিপদে আপনার পাশে দাঁড়ায়!
নিযাম চুপ থাকে। অবাক হয়ে সাইফুলের দিকে তাকিয়ে থাকে।
সাইফুল তার ব্যাগ থেকে দুহাজার আর পাঁচশো টাকার নোট মিলিয়ে ত্রিশ হাজার টাকা এগিয়ে দেয় নিযামের দিকে,
-নিন এতে ত্রিশ হাজার টাকা আছে একটু গুনে নেবেন।
নিযামের দুচোখের কোনা থেকে পানি গড়িয়ে পড়ে। অস্রু মুছে নিযাম স্ত্রীকে ডাকে,
-সালমা এদিকে এসোতো, দেখ না ভাই সাহেব কি বলছেন।
-আমি সব শুনেছি।
-হ্যাঁ বোন, গতকাল তোমাদের কথা গুলো আমার কানে আসার পর থেকে সারারাত আমি ঘুমাতে পারিনি। আমার হজ্জের নিয়তে রাখা কিছু টাকা যদি আমার কোন বোনের চিকিৎসায় খরচ হয় তবে আমার মনে হয় আমার পূর্ণ কোন অংশে কম হবে না। দয়াকরে এটা গ্রহন করুন।
নিযাম হাত বাড়িয়ে টাকাটা নিল, দুচোখের পানি আটকাতে পারল না। সেই সঙ্গে সালমারও চোখে পানি এসে যায়।
-আমি এবার উঠব নিযাম সাহেব। দয়াকরে অপারেশনের তারিখটা জানাবেন।
সালমা এবার আর চুপ থাকতে পারল না। সে বললো, ভাই বোনের এ বিপদে পাশে দাঁড়াবে আর ভরদুপুরে না খেয়ে চলে যাবে এটা কখনো হয়?
-না বোন, আজ না। সামিমভাইকে বলা আছে। ভাবি রান্না করে রাখবে। না গেলে রাগ করবেন। আমি কথা দিচ্ছ তুমি সুস্থ্য হয়ে উঠলে সপরিবারে আমরা আসব।
-কথা দিচ্ছেন কিন্তু। সালমা বলে।
নিযাম বলে, আপনি যখন আজ এখানে খাবেন না আর আপনাকে বেশী জোর করব না। অপারেশানের দিনে আপনাকে থাকতে হবে, আমি আগেভাগই আপনাকে জানাব।
-ঠিক আছে ঐ কথাই থাকল। দোআ করবেন।
-ফী আমানিল্লাহ।
সালমা-নিযাম সাইফুলের চলে যাওয়া বাইকের ধোঁয়ার দিকে উদাসভাবে তাকিয়ে ভাবতে থাকে এখনো মানুষ মানুষের কথা ভাবা ছেড়ে দেয়নি, তা না হলে রাত না পোহাতে এমন মানুষকে আল্লাহ কেন পাঠাবেন!