অনুসন্ধানী কলম: ইনস্ট্যান্ট তিন তালাক ও ইশরাত জাহান ■ জিম নাওয়াজ ■ বিষয়টি শুধুমাত্র বাংলা নয়, ভারতবর্ষ অতিক্রম করে আন্তর...
অনুসন্ধানী কলম:
ইনস্ট্যান্ট তিন তালাক ও ইশরাত জাহান
■ জিম নাওয়াজ ■
বিষয়টি শুধুমাত্র বাংলা নয়, ভারতবর্ষ অতিক্রম করে আন্তর্জাতিকভাবে প্রচারের আলোয় এসেছে। আমি এও জানি, এবিষয়ে আলটপকা কথা লিখলে কিংবা বানোয়াট তথ্যপ্রমাণের উল্লেখ করলে আমার বিরুদ্ধে মামলা হতে পারে। তাই, ঘটনা পরম্পরায় উল্লেখিত তথ্যপ্রমাণগুলি আমি নিজেই যাচাই করেছি। তথ্যপ্রমাণ হিসেবে রয়েছে- হাওড়া কোর্টের রায়ের কপি, চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কমিটির নির্দেশ কপি, অডিও, ভিডিও, ফোন রেকর্ডিং, মৌখিক বয়ান এবং কিছু চিঠিপত্র। তথ্যপ্রমাণ সম্বলিত লেখাটির আইনি দিকগুলি খতিয়ে দেখেছেন কোলকাতা হাইকোর্টের এক বিশিষ্ট আইনজীবী। এবং লেখটি প্রকাশের জন্য তাঁর থেকে অনুমোদনও নিয়েছি।
আরেকটি বিষয়, লেখাটির মধ্যে কোথাও ব্যক্তি আক্রমণের প্রচেষ্টা করিনি। আমি বিশ্বাস করি, ব্যক্তি আক্রমণ তথ্যপ্রমাণ এবং যুক্তিকে দুর্বল করে দেয়। যেহেতু বিষয়ের মূলে রয়েছে ব্যক্তিগত সম্পর্ক, তাই প্রয়োজনের তাগিদে স্বাভাবিকভাবেই কিছু ব্যক্তিগত বিষয় আলোচনা করেছি। অবশ্যই ব্যক্তি কুৎসার জন্য নয়, বিষয়টি ঠিকঠাক বুঝে নেওয়ার জন্য।
ইশরাত জাহান বিজেপিতে যুক্ত হয়েছেন, খবরটি আগের রাতেই নিউজ চ্যানেলের মাধ্যমে শুনেছিলাম। পরেরদিন সকালে সর্বভারতীয় ইংরেজি পত্রিকা দ্য হিন্দুতে খবরটি পড়ার সময় শেষ অনুচ্ছেদে বাংলা বিজেপি নেত্রী লকেট চ্যাটার্জীর বক্তব্যে চোখে আটকে যায়।
“We have been collaborating with her and providing her legal assistance in her battle against triple talaq for a long time. It would be wrong to assume that her move join BJP was a sudden decision”
অর্থাৎ “তিন তালাকের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য আমরা দীর্ঘদিন ধরেই তাকে আইনি সাহায্য করে আসছিলাম। তিনি বিজেপিতে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হঠাৎ করে নিয়েছেন এমন ভাবাটা ভুল।“
বিজেপি দীর্ঘদিন ধরেই ইশরাত জাহানকে আইনি সাহায্য করে আসছে! ইশরাত জাহান দীর্ঘদিন ধরেই বিজেপির আশ্রয়ে রয়েছেন! হতচকিত হলাম এবং ফিরে গেলাম ফ্ল্যাশব্যাকে।
গতবছর অর্থাৎ ২০১৭ সালের ২২শে আগস্ট ভারতের সুপ্রিমকোর্টের পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চের ৩:২ রায়ে, তালাক ই বিদ্দাত অর্থাৎ ইনস্ট্যান্ট তিন তালাক অবৈধ ঘোষিত হওয়ার সাথেসাথেই সংবাদমাধ্যম এবং বিজেপি নেতানেত্রীরা আনন্দে উৎসবে ফেটে পড়েন। রায় প্রকাশের দুএকদিন পরেই একটি রাজনৈতিক দলের রাজ্যস্তরের নেতা আমায় ফোন করে জানান, ইশরাত জাহানকে নানানভাবে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। বর্তমানে ইশরাত জাহান আর্থিক সমস্যায় ভুগছেন। উল্লেখ্য, সেই নেতা আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ইশরাতকে হুমকি দেওয়া হচ্ছে, একথা শোনার পরে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হই। বিভিন্ন মুসলিম সংগঠনের নেতানেত্রীদের ফোন করে ইশরাত জাহানের পাশে দাঁড়ানোর আবেদন জানাই। এমনকি, বিষয়টি নিয়ে নিজের পরিবারের সাথেও বাকযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ি। দাদা এবং আম্মাজীর বক্তব্য ছিল, মুসলিম নেতারা ইশরাত জাহানের পাশে থাকেননি এটা অন্যায়। কিন্তু তিনি কি মুসলিম নেতাদের কাছে গিয়েছিলেন?
সেসময়ে মুসলিম নেতা থেকে শুরু করে নিজের পরিবারের সদস্যের বক্তব্যগুলি আমার কাছে নেহাতই অজুহাত ছাড়া আর অন্যকিছু মনে হয়নি। এরপর, ইশরাত জাহানের ফোন নম্বর জোগাড় করে আমি নিজেই তাঁর সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করি। জানাই, সামাজিক এবং আর্থিকভাবে তাঁর পাশে থাকতে চাই। কিন্তু তিনি আমার সাথে কথা বলতে রাজি হননি। তাঁর আইনজীবী নাজিয়া ইলাহী খান- এঁর সাথে কথা বলতে বলা হয়। যোগাযোগ করে উঠতে পারিনি। বেগতিক দেখে, নারী ও আদিবাসীদের আর্থসামাজিক আন্দোনলের সাথে যুক্ত এক আপার সাথে কথা বলি এবং ইশরাত জাহানের সাথে যোগাযোগ করে দেওয়ার অনুরোধ করি। তিনিও ব্যর্থ হন। এরপর আমি নিজেও চুপ করে যাই। তারপর সাম্প্রতিক দ্য হিন্দু পত্রিকায় লকেট চ্যাটার্জীর বিবৃতি এবং সেই বিবৃতির পরিপ্রেক্ষিতে শুরু হয় আমার ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং।
হাওড়ার মেয়ে ইশরাত জাহানঃ
ইনস্ট্যান্ট তিন তালাক নিয়ে সুপ্রিমকোর্টের রায়ের সময় সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত হয়, ইনস্ট্যান্ট তিন তালাক মামলায় যে পাঁচজন পিটিশনার ছিলেন তাঁদের অন্যতম আমাদের বাংলা তথা হাওড়ার মেয়ে ইশরাত জাহান। শোনার পরে বেশ আনন্দই হয়েছিল। বাহ, আমাদের বাংলার মেয়েও রয়েছেন যিনি এমন একটি ঐতিহাসিক লড়াইয়ের সেনাপতি! কিন্তু ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং-এর পরে আমার সেই আনন্দ একেবারেই বিলীন হয়ে যায়। ইশরাত জাহান বাংলা লিখতে, পড়তে, বলতে, এমনকি বুঝতেও পারেন না। বাংলার মেয়ের পক্ষে এটা কীভাবে সম্ভব! সত্যি কথা বলতে, ইশরাত বাংলার মেয়েই নয়। ইশরাতের বাবার বাড়ি বিহারের নওদা জেলার পকরী বরাওয়া গ্রামে। বাবা মোহাঃ হাসিব পেশায় দর্জি। তিনি সেখানেই পড়াশুনা করেন এবং বিহার বোর্ড থেকে মাধ্যমিক উত্তীর্ণ হন। মাধ্যমিক পাশের পরে ২০০১ সালে ইশরাতের বিয়ে হয় বিহারের অরঙ্গাবাদ জেলার ইটাওয়া নিবাসী মোহাঃ মোর্তজা আনসারীর সাথে। ইশরাতের স্বামী মোর্তজাও বিহার বোর্ড থেকেই মাধ্যমিক পাশ করেন। অর্থাৎ বাবা এবং শ্বশুরবাড়ি- কোনোদিক থেকেই ইশরাত বাংলার নয়, বিহারের মেয়ে। এখন প্রশ্ন হল, তথ্য গোপন করে ইশরাতকে বাংলার মেয়ে ব’লে ব্যাপক প্রচারের পেছনে সংবাদমাধ্যমের আসল উদ্দেশ্য কি? ইশরাতের সপক্ষে বাঙালি জাতীয়তাবোধ চাগিয়ে তোলা!
ইশরাত জাহানের হাওড়ায় আগমনঃ
২০০১ সালে বিয়ের পরে ইশরাত শ্বশুর বাড়িতে স্বামীর সাথে সংসার শুরু করেন। একসাথে ছয়মাস থাকার পরে রোজগারের তাগিদে স্বামী মোর্তজা তাঁর স্ত্রী ইশরাতকে মায়ের কাছে রেখে পুনরায় দুবাই পাড়ি দেন। ২০০৩ সালে ইশরাত জাহানের শাশুড়ি হার্ট অ্যাটাকে মারা যান। এরপর মোর্তজা তাঁর গর্ভবতী স্ত্রীকে হাওড়ার লিলুয়ার ফ্ল্যাটে দাদা-ভাবীর কাছে রেখে দুবাই পাড়ি দেন। উল্লেখ্য, মোর্তজা আনসারীর দাদা মোস্তফা আনসারী পেশায় প্রাইমারী স্কুল শিক্ষক। ফ্ল্যাটটি দুই ভাইয়ের নামেই রয়েছে।
ইশরাত জাহানের হাওড়া-বিহারঃ
ভাসুরের সংসারে থাকার কিছুদিন পর থেকেই ইশরাত জাহানের সাথে তার জা-এর সাংসারিক ঝামেলা শুরু হয়। সাংসারিক সমস্যার জন্য ইশরাত এবং মোর্তজা প্রায় দীর্ঘ সাতবছর মোস্তফা ও তার স্ত্রীর সাথে কথা বন্ধ করে দেন। এরপর থেকে বেশিরভাগ সময়েই ইশরাত থাকতেন বিহারে তাঁর শ্বশুরবাড়িতে। যখন যখন মোর্তজা দুবাই থেকে ফিরতেন, তখন তখন কিছুদিন হাওড়ায় স্ত্রীকে নিয়ে থাকতেন। দুবাই যাওয়ার সময় আবার স্ত্রীকে বিহারে রেখে চলে যেতেন। অর্থাৎ দাম্পত্য জীবনের আগে পুরোটাই এবং পরে বেশিরভাগ সময় ইশরাত বিহারে থেকেছেন। তবে, ২০১৩ সাল থেকে ইশরাত বাচ্চাদের গ্রামের বাড়িতে রেখে মাঝেমাঝেই হাওড়ায় এসে থাকতেন।
ইশরাত জাহানের সাথে স্বামী মোর্তজার ঝামেলাঃ
ইশরাতের সাথে তাঁর স্বামীর ঝামেলা শুরু হয় মূলত ২০১৩ সাল থেকে। ঝামেলার কারণ, ইশরাত হাওড়ার ফ্ল্যাটে থাকতে চেয়েছিলেন। কিন্তু স্বামী বলেছিলেন, বিহারে গ্রামের বাড়িতে থাকতে। প্রশ্ন হল, স্বামী তো থাকেন দুবাইতে। ইচ্ছানুসারে ইশরাত যদি হাওড়াতেই থাকেন তাহলে সমস্যা কোথায়? ইশরাতের স্বামী মোর্তজার বক্তব্য অনুযায়ী, “কয়েকজনের থেকে খবর পাই, হাওড়ায় থাকাকালীন ইশরাত বাচ্চাদের বাড়িতে রেখে সকালে বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাতে ফিরতেন। অনেক সময় বাড়ি ফিরতে রাত বারোটা বেজে যেতো।“ এরপর মোর্তজা অভিযোগ করেন, “ সময়টা ২০১৪ সাল।একদিন দুবাই থেকে দুপুরবেলা ফোন করেছিলাম। পাশ থেকে একজন ব্যক্তিকে চাপা সুরে বলতে শুনি, কোন ফোন কিয়া রে? ইশরাত চাপা গলায় উত্তর দেয়, পাগলা ফোন কিয়া। একথা শুনে আমি অল্প জামাকাপড় নিয়ে চড়া দামে এয়ারপোর্ট থেকে টিকিট কিনে সরাসরি কোলকাতায় ফিরে আসি। ফিরেই ঝামেলা শুরু হয়। স্ত্রীর সাথে ঝামেলা হাতাহাতির পর্যায়ে পৌঁছে যায়। বাচ্চাদের নিয়ে চলে যাই বিহারে গ্রামের বাড়িতে। এনিয়ে ইশরাত আমার বিরুদ্ধে হাওড়ার গোলাবাড়ি থানায় আইপিসি 498(A)তে এফ আই আর করে। কেস নম্বর- ১০৮৫/২০১৪, তারিখ ২৪/১০/২০১৪। অবশ্য একমাস পরে অর্থাৎ ২৪/১১/২০১৪তে ইশরাত নিজেই হাওড়াকোর্ট থেকে আমার জামিন করিয়ে নেয়। বাচ্চাদের নিয়ে আমি আবার হাওড়ার ফ্ল্যাটে ফিরে আসি। কোর্টের আদেশ অনুসারে আমরা আবার হাওড়ার ফ্ল্যাটে একসাথে থাকতে শুরু করি।“ বলে রাখা ভালো, কেস এবং জামিনের সমস্ত কপিই আমার কাছে রয়েছে।
ইশরাত জাহানের বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কঃ
মোর্তজা আনসারী অভিযোগ করেন, “জামিনের কয়েকদিন পরেই ০৩/১২/২০১৪ তারিখে ইশরাত একটি চিঠি লিখে বাচ্চাদের বাড়িতে রেখে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যান।“ উল্লেখ্য, তিন পাতার চিঠির কপিটি আমার কাছে রয়েছে। চিঠিটি ইশরাতেরই লেখা কিনা তা যাচাই করার জন্য আমি ইশরাতের একাধিক লেখাপত্র জোগাড় করি। এবং নিশ্চিত হই, চিঠিটি ইশরাতেরই লেখা। ০৪/১২/২০১৪ তারিখে হাওড়ার গোলাবাড়ি থানায় মোর্তজা একটি নিখোঁজ ডায়েরী করেন। সেই ডায়েরীর কপিটিও সংগ্রহ করেছি। অবশ্য নিখোঁজের দুদিন পরেই এক আত্মীয়ের বাড়ি থেকে ইশরাতকে ফিরিয়ে নিয়ে আসা হয়। চিঠিটিতে ইশরাত বলেন,” আমি তোমার সাথে আর প্রতারণা করতে পারবো না। বাড়ি ছেড়ে চলে গেলাম। তুমি তালাকনামা তৈরি রেখো। আমি সময় করে নিয়ে যাবো।“
মোর্তজা দাবী করেছেন, “আমার স্ত্রীর সাথে তার গ্রামেরই আফজাল ওরফে রাজু নামের একটি ছেলের সাথে প্রেমের সম্পর্ক ছিল। এখবরটি আমি বাচ্চাদের থেকে জানতে পারি। বাচ্চারা আমায় জানায়, বিভিন্ন সময়ে মা এবং রাজুমামা ঘুরতে বেরিয়ে যেত।“ মোর্তজা আনসারী অভিযোগ করেছেন, ২০০৯ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত ইশরাত চারবারেরও বেশি ছোটবেলার প্রেমিক আফজাল ওরফে রাজুর সাথে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছেন।
রামপুরহাটে ইশরাত জাহানঃ
মোর্তজা দাবী করেছেন, ২০১৩-১৪সালে ইশরাত জাহান তার বাচ্চাদের নিয়ে রাজুর সাথে বীরভূম জেলার রামপুরহাট গিয়েছিলেন এবং একমাসেরও বেশি একসাথে ছিলেন। রামপুরহাটে তিনি অমরজিত দে নামক এক ব্যক্তির শ্বশুরবাড়িতে ছিলেন। এই তথ্যটি যাচাই করার জন্য আমি অমরজিতবাবুর সাথে যোগাযোগ করি। তিনি ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, আমার স্ত্রীর ক্যান্সার হয়েছিল। চিকিৎসা করাতে কোলকাতা গিয়েছিলাম। সেই সূত্রে আমার সাথে ইশরাত জাহানের পরিচয়। কোলকাতা গেলে আমরা ইশরাতের ফ্ল্যাটেই থাকতাম, খেতাম। আমাদের মধ্যে গভীর আত্মীয়তার সম্পর্ক গড়ে ওঠে।“ ইশরাতের সাথে আফজালের রামপুরহাটে একসাথে থাকার প্রসঙ্গে বলেন, “ ইশরাত আফজালকে নিজের ভাই পরিচয় দিয়ে এখানে তিনি ছিলেন।“ এছাড়া রামপুরহাটের আরও দুজনের থেকে ঘটনার সত্যতা যাচাই করেছি।
ইশরাত জাহানের অন্তর্ধানঃ
আগেই উল্লেখ করেছি, পিএস কেস নম্বর- ১০৮৫/২০১৪, আনডার সেকশন ৪৯৮/৪০৬/আইপিসি ৩/৪ ডিপি এক্ট-এর ভিত্তিতে হাওড়া কোর্ট স্বামী এবং স্ত্রী ইশরাত জাহানকে একসাথে থাকার নির্দেশ দেয়। তাঁরা একসাথে থাকতে শুরুও করেন। কয়েকদিন পরে ইশরাত জাহান স্বামীর থেকে তালাক চেয়ে চিঠি লিখে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান। এই মর্মে মোর্তজা আনসারী গোলাবাড়ি থানায় একটি নিখোঁজ ডায়েরী করেন। দুদিন পরে এক আত্মীয়ের বাড়ি থেকে ইশরাতকে ফিরিয়ে নিয়ে আসা হয়। একসাথে থাকতে শুরু করলেও সংসারে আর শান্তি ফিরে আসেনি। ২০১৫ সালের জানুয়ারী মাসের প্রথম সপ্তাহে ইশরাত জাহান এবং মোর্তজার মারামারি হয়। মোর্তজা চার সন্তানকে নিয়ে বিহারের গ্রামের বাড়িতে ফিরে যান। ইশরাত রয়ে যান হাওড়াতেই। কয়েকদিন পরে, ২০১৫-এর জানুয়ারী মাসের মাঝামাঝি সময়ে, ইশরাত জাহানও বিহারের শ্বশুরবাড়িতে পৌঁছান। চারদিন পরেই মোর্তজার দুবাই রওনা হওয়ার কথা। কোলকাতায় থাকা নিয়ে সেখানে ইশরাত এবং মোর্তজার মারামারি হয়। সেই মারমারিতে মোর্তজার মাথা ফেটে যায়। মোর্তজা স্ত্রীর নামে হাসপুরা থানায় ডায়েরী করতে গেলে, থানা স্বামী-স্ত্রীর ঝামেলা নিজেদের মধ্যেই মিটমাট করে নিতে বলে। মাথায় ব্যান্ডেজ নিয়েই মোর্তজা দুবাই রওনা দেন।
এরপর, ইশরাত বাচ্চাদের সাথে নিয়ে কয়েকদিন শ্বশুরবাড়িতে থাকেন। কিন্তু, ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারী মাসের ১০ তারিখে ছয় বছরের বাচ্চা থেকে শুরু করে এগারো বছর বয়স পর্যন্ত চারজন সন্তানকে বাড়িতে রেখে চলে যান। এরপরে আর তিনি গ্রামের শ্বশুর বাড়িতে ফেরেননি।
সন্তানসন্ততি এবং তাদের দেখাশনাঃ
ইশরাত এবং মোর্তজার চারজন সন্তানের মধ্যে, ২০১৫ সাল অনুযায়ী, ১১ বছর বয়সী সায়িস্তা খাতুন, ৯ বছর বয়সী কাহকাশা খাতুন, ৮ বছর বয়সী বুশরা খাতুন এবং ৬ বছর বয়সী মোহাঃ জায়েদ আফজাল রয়েছে। উল্লেখ্য, কনিষ্ঠ পুত্র সন্তান মোহাঃ জায়েদ ‘আফজাল’-এর নামকরণ করেন ইশরাত জাহান নিজেই। বাচ্চাদের বাড়িতে ছেড়ে চলে যাওয়ার পরে, মোর্তজা আনসারীর অনুরোধে তাঁরই এক দিদি তাদের দেখাশনার দায়িত্ব নেন। মোর্তজা আনসারী সেই বয়স্কা দিদিকে টাকা পাঠিয়ে দিতেন। বাচ্চাদের তিনি গ্রামের স্কুলেই ভর্তি করে দেন। জায়েদ আফজাল বাদে আজ অব্ধি প্রতিটি বাচ্চাই গ্রামের স্কুলে পড়াশুনা করে।
ইশরাত জাহানের অন্তর্ধান বিষয়ে থানা এবং কোর্টে রিপোর্টঃ
কয়েকমাস পরে, মোর্তজা আনসারী দুবাই থেকে ফিরে আসেন। দুবাই থেকে ফিরে ২৪শে সেপ্টেম্বর ২০১৫ তারিখে স্থানীয় হাসপুরা থানায় একটি নিখোঁজ ডায়েরী করেন। ডায়েরীর কপিটি আমি সংগ্রহ করেছি। কপিতে থনার কোনও শিলমোহর নেই। থানা থেকে শিলমোহর দেওয়া হয়নি। থানা থেকে শিলমোহর না দেওয়ায় মোর্তজা আনসারী দাউদনগর কোর্টে গিয়ে একটি এফিডেবিট জমা দেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে কোর্ট থেকে হাসপুরা থানায় একটি নোটিশ পাঠানো হয়। নোটিশ নম্বর- ১৬৩৩/২০১৫। কোর্ট থেকে পাঠানো নোটিশের জেরক্স কপিটি আমার সংগ্রহে রয়েছে।
মোর্তজা আনসারীর দ্বিতীয় বিয়েঃ
ছোটছোট চার সন্তানের বিষয়টি মাথায় রেখে গ্রামের বিশিষ্ট লোকদের নিয়ে একটি আলোচনা সভা হয়। সেখানে মোর্তজা আনসারীকে দ্বিতীয় বিয়ের পরামর্শ দেওয়া হয়। বাচ্চাদের কথা চিন্তা করে দ্বিতীয় বিয়েতে তিনি সম্মতিও জানান। বিয়ে ঠিক হয় বাড়ি থেকে তিনঘন্টা দূরত্বে বিহার-ঝাড়খন্ড বর্ডারে অবস্থিত হরিহরগঞ্জ নামে একটি এলাকার এক বিধবা মহিলার সাথে। কন্যাপক্ষের কাছে সমস্ত বিষয় আগে থেকেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল। মোর্তজা আনসারী পাঁচজন ব্যক্তিকে নিয়ে বিয়ের জন্য রওনা হন। কিন্তু বিয়ের দিনে, ইশরাত হরিগঞ্জ থানার কয়েকজন পুলিশকে সাথে নিয়ে কন্যাপক্ষের বাড়িতে পৌঁছে যান। বিয়ের আগেই, পুলিশ সকলকে থনায় তুলে নিয়ে যায়।
এরপর মোর্তজার গ্রামের লোকদের খবর দেওয়া হয়। গ্রামের মুখিয়া(প্রধান)সহ অনেকেই থানাতে আসেন। পুলিশের সামনে ঘটনাগুলি জানানো হয়, এবং তার ভিত্তিতে কাগজপত্র দেখানো হয়। মোর্তজার কাছে জানতে চাওয়া হয়, তিনি কি চাইছেন? মোর্তজা বলেন, “বিয়ে তো আমি সাধ করে করছি না, বাধ্য হয়ে করছি। ইশরাত যদি আমার সাথে থাকতে চায়, তাহলে আমার দ্বিতীয় বিয়ের দরকার নেই । তবে ইশরাতকে কোলকাতায় নয়, গ্রামের বাড়িতে থাকতে হবে। কারণ, আমার বাচ্চারা সকলে গ্রামের স্কুলে পড়াশুনা করে। আমাদের ঝামেলার কারণে বাচ্চাদের এমনিতেই পড়াশুনার বহু ক্ষতি হয়ে গেছে। আর নয়।“ এরপর থানা থেকে মোর্তজাকে বলা হয়, “আপনি যদি গ্রামের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে স্ত্রীর উপর অত্যাচার করেন?” মোর্তজা বলেন, “স্যর এবিষয়ে কাগজপত্র থানা থেকেই তৈরি করে দিন। আমি সাক্ষর করতে রাজী রয়েছি।“ কিন্তু, এই প্রস্তাবে ইশরাত জাহান রাজী হননি। থানা থেকে তিনি বেরিয়ে যান। থানাপুলিশের চক্করে হরিহরগঞ্জের সম্বন্ধটিও ভেঙে যায়।
ঘটনার কয়রকদিম পরে, বিহারের জাহানাবাদ জেলার প্রায় ত্রিশ বছর বয়সী তালাকপ্রাপ্তা সাবানা নামের এক মহিলার সাথে মোর্তজার বিয়ে হয়। বিয়ের শর্ত ছিল, মোর্তজা বাচ্চাদের দেখাশনার জন্য বিয়ে করছেন। এবিষয়ে কোর্টে কাগজও বানানো হয়। দ্বিতীয় স্ত্রীর সন্তান জন্ম নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে মোর্তজা বলেন, “ আমি বিয়ে করেছি বাচ্চাদের দেখাশোনার জন্য। কোর্টে কাগজও বানিয়েছি। নতুন স্ত্রীর থেকে বাচ্চা নেওয়ার প্রশ্নই ওঠেনা।“ মোর্তজার দ্বিতীয় স্ত্রীই এখন বাচ্চাদের দেখাশোনা শুরু করেন।
মোর্তজার বিরুদ্ধে হাওড়া কোর্টে ইশরাত জাহানের ক্রিমিনাল কেসঃ
ইতিমধ্যে, ইশরাত জাহান হাওড়ায় ফিরে আসেন। এবং হাওড়া ক্রিমিনাল কোর্টে মোর্তজা আনসারী, মোর্তজা আনসারীর দাদা মোস্তফা আনসারী এবং মোস্তফা আনসারীর স্ত্রী জাবীনা খাতুনের বিরুদ্ধে পণ ও নির্যাতনের জন্য মামলা দায়ের করেন। মিসলেনিয়াস কেস নম্বর-৭২১/২০১৫, তারিখ-১৪/১০/২০১৫। কোর্টে এফিডেবিট দাখিল করে ইশরাত জানান,
তাঁর স্বামী মোর্তজা আনসারী এবং অন্য দুই অভিযুক্ত শারীরিক এবং মানসিক অত্যাচার করে। এই অত্যাচার করা হয়েছিল তাঁর বাবার থেকে পণ আদায়ের জন্য। বিয়ের সময়, এখন যে ফ্ল্যাটে থাকেন সেই ফ্ল্যাটটি কেনার জন্য বাবার থেকে পণ হিসেবে পাঁচ লক্ষ টাকা দাবী করা হয়। বর্তমানে অতিরিক্ত দুই লক্ষ টাকার জন্য অত্যাচার করা হচ্ছে। এরসাথে কোর্টের কাছে ইশরাত আবেদন করেন, দোষীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থাসহ মামলার খরচ পঞ্চাশ হাজার টাকা এবং চিকিৎসা খরচ পাঁচ হাজার টাকা আদায় এবং দুই লক্ষ টাকা জরিমানা হিসেবে আদায় করে দেওয়া হোক।
উক্ত ক্রিমিনাল কেসটির নিষ্পত্তি হয় গত ২০১৭ সালের ১৮ই মার্চ। হাওড়া ক্রিমিনাল ৫নম্বর কোর্টের ফার্স্টক্লাস জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ইশরাত জাহানের দায়ের করা মামলাটি খারিজ করে দেন।
মোস্তফা আনসারীর বিরুদ্ধে গোলাবাড়ি থানায় এফ আই আরঃ
২০১৫ সালের ডিসেম্বর মাসের ২৮ তারিখে, ইশরাত জাহান তাঁর ভাসুর মোস্তফা আনসারীর বিরুদ্ধে এফ আই আর করেন। এফ আই আর নম্বর-১৫৩৩, সেকশন-৩৪১/৩২৩/৩৫৪/৫০২। এফ আই আর-এর সাক্ষী হিসেবে প্রতিবেশী জসিম খান এবং তাঁর স্ত্রী সনি বেগমের নাম রাখা হয়। এফ আই আর এবং সাক্ষীদের বয়ান অনুযায়ী, ০২/১২/২০১৫ তারিখে ভাসুর মোস্তফা আনসারী বেলা ১১টার সময় শ্লীলতাহানি করেন এবং প্রচন্ড মারধোর করেন। কিন্তু, প্রাইমারী স্কুল শিক্ষক মোস্তফা আনসারীর এটেনডেন্স রেজিস্টার থেকে দেখা যায়, ঘটনার দিন তিনি ১০টা বেজে ৪০ মিনিটে সই করেছেন। ফ্ল্যাট থেকে স্কুলের দূরত্ব প্রায় ১৫ কিলোমিটার। দ্বিতীয়ত, সাক্ষী সনি বেগমের সাথে আমি নিজে যোগাযোগ করি। তিনি জানান, তাঁরা এরকম কোনও সাক্ষী দেননি। পুলিশ তাদের কিছু জিজ্ঞেস করেনি। মামলাটি এখন বিচারাধীন।
ইনস্ট্যান তিন তালাকের বিরুদ্ধে ইশরাত জাহানের পিটিশন দাখিলঃ
সুপ্রিমকোর্টে এক হিন্দু মহিলার মামলার শুনানি চলছিল। মহিলা অভিযোগ করেন, তাঁর স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন। কোর্ট সেই মহিলাকেই স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ের বিষয়টি প্রমাণ করতে বলে। হিন্দু বিবাহ আইন অনুযায়ী, কন্যাদান পদ্ধতিতে বিয়ে না করলে সেই বিয়ে বৈধ হয়না। স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে কন্যাদান পদ্ধতি করেননি, তাই সুপ্রিমকোর্ট আইনি বাধ্যবাধকতার কথা জানিয়ে মামলাটি খারিজ করে দেয়। একই মামলার রায়দানের সময়, ২০১৬ সালের ২৯শে ফেব্রুয়ারী, বিচারক অনিল দাভে এবং এ,কে গোয়েল তাদের রায়ের অবজার্ভেশনে মুসলিম সম্প্রদায়ের ইনস্ট্যান্ট তিন তালাক নিয়ে প্রশ্ন তোলেন এবং নোটিশ ইস্যু করেন। হিন্দু বিবাহ আইনি জটিলতার কারণে হিন্দু মহিলা ন্যায় বিচার পেলেন না, কিন্তু অযাচিতভাবে একই রায়ে সুপ্রিমকোর্ট ইনস্ট্যান্ট তিন তালাকের বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। এবিতর্ক অবশ্য ভিন্ন। যাইহোক, সুপ্রিমকর্টের নোটিশের ভিত্তিতে ইশরাত জাহানের পিটিশনটি দাখিল করা হয় ২০১৬ সালের আগস্ট মাসের ১২ তারিখে। অর্থাৎ সুপ্রিমকোর্টের নোটিশ জারী এবং সেনিয়ে মিডিয়া ট্রায়াল ও সরকারের অবস্থানে প্রায় সাড়ে পাঁচ মাস পরে ইশরাত জাহানের আইনজীবী ভিকে বিজু এবং নাজিয়া ইলাহী খান পিটিশন দাখিল করেন। পিটিশনটি তৈরি করেন মূলত আইনজীবী ভিকে বিজু। সহকারী হিসেবে ছিলেন নাজিয়া এলাহী খান। অনেক বক্তব্যের সাথে ৩৪ পাতার পিটিশনে বলা হয়, মোহাঃ মোর্তজা আনসারী ভিক্টিম ইশরাত জাহানকে ২০১৫ সালের এপ্রিল মাসে দুবাই থেকে ফোনের মাধ্যমে তালাক তালাক তালাক উচ্চারণে ইনস্ট্যান্ট তিন তালাক দেন এবং ফোনটি কেটে দেন।
ইনস্ট্যান্ট তিন তালাক নিয়ে মোর্তজার বক্তব্যঃ
ইশরাত জাহান তাঁর পিটিশনে দাবী করেছেন, ২০১৫ সালের এপ্রিল মাসে তাঁর স্বামী মোর্তজা আনসারী তাঁকে ফোনের মাধ্যমে ইনস্ট্যান্ট তিন তালাক দেন। কিন্তু মোর্তজা আনসারী সেই অভিযোগ প্রথম থেকেই অস্বীকার করে আসছেন। রায়ের আগে, ইনস্ট্যান্ট তিন তালাকের শুনানি নিয়ে যখন সারা দেশ এবং মিডিয়া তোলপাড়, সেই সময় দাদা মোস্তফার থেকে ফোন নম্বর জোগাড় করে একটি সর্বভারতীয় ইংরেজী নিউজ চ্যানেল মোর্তজাকে ফোনও করে এবং তালাক দেওয়ার বিষয়টি জানতে চায়। মোর্তজা পরিষ্কার জানিয়ে দেন, তিনি তালাক দেননি। এরপরেও সব সময়েই তিনি বলে এসেছেন, তিনি ইশরাত জাহানকে তালাক দেননি।
ইনস্ট্যান্ট তিন তালাকের আসল রহস্যঃ
একদিকে ইশরাত জাহান বলছেন, ফোনে তাঁর স্বামী তাকে তালাক দিয়েছেন। অন্যদিকে, মোর্তজা বলছেন, তিনি আজ অব্ধি তালাক দেননি। কার কথা সত্য?
এবিষয়ে আমি নিজে নথিপত্রগুলি যাচাই শুরু করি। মোর্তজা আনসারী গোলাবাড়ি থানা, হাসপুরা থানা, হাওড়া কোর্ট এবং শেষ ২০১৫ সালের ২৯শে ডিসেম্বর বিহারের দাউদপুর কোর্টে যে ইনফর্মেশন এফিডেবিট দাখিল করেন, সেখানে কোথাও তিনি ইশরাত জাহানকে প্রাক্তন স্ত্রী বলে উল্লেখ করেননি। বরং প্রতিটি স্থানেই তিনি ইশরাতকে বর্তমান স্ত্রী বলেই উল্লেখ করেছেন। প্রশ্ন হল, তিনি যদি সত্যিই ২০১৫ সালের এপ্রিল মাসে ইনস্ট্যান্ট তিন তালাক দিয়ে থাকেন, তাহলে আট-নয় মাস পরে ২০১৫ সালের ২৪শে ডিসেম্বর হাসপুরা থানায় নিখোঁজ ডায়রী কিংবা ২৯শে ডিসেম্বর দাউদপুর কোর্টে ইশরাতের নিখোঁজ ইনফর্মেশন দেওয়ার সময় ইশরাত জাহানকে তালাকপ্রাপ্ত প্রাক্তন স্ত্রী উল্লেখ না করে বর্তমান স্ত্রী হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন কেন? তখন তো সুপ্রিমকোর্ট থেকে ইনস্ট্যান্ট তিন তালাক অসাংবিধানিক ঘোষিত হয়নি। এনিয়ে মিডিয়া ট্রায়ালও শুরু হয়নি। দ্বিতীয়ত, মোর্তজা শুরু থেকে আজ অব্ধি ইশরাতের সাথে সংসার করতে রাজী রয়েছেন। ইনস্ট্যান্ট তিন তালাক নিয়ে রায়ের সময় আনন্দবাজার পত্রিকায় মোর্তজার একটি বক্তব্য ছাপা হয়। সেখানে তিনি বলেন, ইশরাত যদি নিজেকে শুধরে নেয়, তাহলে এখনও তিনি তার সাথে সংসার করতে রাজী রয়েছেন। তিন তালাক পতিত হওয়ার পরে কি নতুন করে সংসার করার প্রভিশন থাকে? সেইসময় ছিল?
ইশরাত জাহান সুপ্রিমকোর্টে দাখিল করা পিটিশনে উল্লেখ করে ২০১৫ সালের এপ্রিল মাসে তাঁকে ইনস্ট্যান্ট তিন তালাক দেওয়া হয়েছে। হাওড়া ক্রিমিনাল কোর্টে ইশরাত স্বামী, ভাসুর এবং জা-এর বিরুদ্ধে পণ ও নারী নির্যাতনের মামলা করেছিলেন ১৪ই অক্টোবর, ২০১৫ সালে অর্থাৎ ইশরাতের পিটিশন অনুযায়ী তালাক দেওয়ার প্রায় ছয় মাস পরে। অদ্ভুতভাবে, ইশরাত সেই মামলার এফিডেবিটেও ইনস্ট্যান্ট তিন তালাকের কথা উল্লেখ করেননি। বরং তিনি মোর্তজাকে লিগ্যাল স্বামী হিসেবেই উল্লেখ করেছেন।
অর্থাৎ ফ্যাক্ট থেকে পরিষ্কার, ইশরাত জাহানকে মোর্তজা আনসারী দুবাই থেকে ফোনের মাধ্যমে ইনস্ট্যান্ট তিন তালাক দেননি। ইশরাতের অভিযোগ সম্পূর্ণই বানোয়াট। এক্ষেত্রে মোর্তজাই সত্যি কথা বলছেন।
সুপ্রিমকোর্টের রায় এবং ইশরাত জাহানঃ
অনেকেই ভাবতে পারেন, মোর্তজা যদি তিন তালাক না দিয়েই থাকেন, তাহলে সুপ্রিমকোর্ট কিসের ভিত্তিতে ইশরাতের পক্ষে রায় দিল?
মনের ভিতর এমন প্রশ্ন আসা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু মনে রাখতে হবে, সুপ্রিমকোর্টের রায় ছিল সার্বিক ইনস্ট্যান্ট তিন তালাকের উপর। সার্বিকভাবে সুপ্রিমকোর্ট ইনস্ট্যান্ট তিন তালাক অসাংবিধানিক ঘোষণা করেছে। সুপ্রিমকোর্টে এই নিয়ে আর্গুমেন্ট হয়নি যে, ইশরাত জাহানকে তাঁর স্বামী তালাক দিয়েছিলেন কি দেননি? কিংবা পিটিশনের মধ্যে সত্যতা আছে কি নেই? তাই সুপ্রিমকোর্টের রায়ের ভিত্তিতে কখনই এই সিদ্ধান্তে আসা যেতে পারেনা যে, মোর্তজা আনসারী তাঁর স্ত্রীকে ইনস্ট্যান্ট তিন তালাক দিয়েছিলেন।
ইশরাতের সন্তানদের কিডন্যাপ রহস্যঃ
বিহারে শ্বশুরবাড়িতে ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে সন্তানদের ছেড়ে চলে যাওয়ার পরে, ২০১৭ সালের প্রথম দিকে ইশরাত জাহান শ্বশুরবাড়ি গ্রাম থেকে বড়ো মেয়ে এবং ছোট ছেলেকে নিয়ে হাওড়ায় চলে আসেন। কয়েকদিন বাইরে থাকার পরে, হাওড়া ফ্ল্যাটে ওঠেন। মাঝের দুজন সন্তান থেকে যায় গ্রামের বাড়িতেই। এরপর থেকে ইশরাত নিয়মিত স্বামী মোর্তজা আনসারীর ফ্ল্যাটেই থাকেন।
২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে, বকরা ঈদের সময় মোর্তজা দুবাই থেকে পাটনা এয়ারপোর্ট হয়ে গ্রামের বাড়িতে চলে যান। ঈদের দুদিন পরে তিনি হাওড়ার ফ্ল্যাটে আসেন। মোর্তজার বক্তব্য অনুযায়ী, “বাচ্চারা গ্রামের বাড়িতে যেতে চাইলে ইশরাত গেটে তালা ঝুলিয়ে দেয়। বাচ্চারাই মোর্তজাকে ডুপ্লিকেট চাবির সন্ধান দেয়। মোর্তজা সেই চাবি দিয়ে তালা খুলে প্রথমে বাচ্চাদের জামা-কাপড় কিনে দেওয়ার জন্য বাজারে যায়। ইতিমধ্যেই, ইশরাত জাহান এবং তার আইনজীবী নাজিয়া ইলাহী গোলাবাড়ি থানায় গিয়ে অভিযোগ করেন, বাচ্চাদের কিডন্যাপ করা হয়েছে। খবরটি বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম এবং সোশ্যাল মাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়। কিন্তু, কিডন্যাপ হওয়া বাচ্চাগুলি উদ্ধার করা গিয়েছে কিনা, উদ্ধার করা গেলে তাদের এখন কি পরিস্থিতি, কিডন্যাপার খেতে দিয়েছিল কিনা, কতজন কিডন্যাপার ছিল, মারধোর করেছিল কিনা, হাত খোলা নাকি বেঁধে রেখেছিল, কিডন্যাপ করার সময় চোখেমুখে কাপড় বেঁধে নিয়ে গিয়েছিল কিনা- ইত্যাদি বিষয় নিয়ে মিডিয়াতে আর তেমনভাবে কিছুই আলোচনা হয়নি। কিডন্যাপার হিসেবে দাদা মোস্তফা আনসারী নাম উল্লেখ করা হয়। পুলিশ ফোন করে মোস্তফাকে থানায় ডাকে। স্কুল থেকে তিনি থানায় চলে যান। গিয়ে বলেন, বাচ্চারা বাবার সাথে গিয়েছে। এরপর মোস্তফা ফোন করে মোর্তজাকে থানায় ডেকে পাঠান। দুই বাচ্চাকে নিয়ে মোর্তজা সন্ধ্যে ছটার মধ্যে থানায় উপস্থিত হন। জোর করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল কিনা, পুলিশ সেকথা জানতে চায়। কিন্তু বাচ্চারা বাবার সাথেই থাকার কথা জানিয়ে দেয়।
এরপর লিলুয়ার চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কমিটিতে মামলাটি পাঠানো হয়। বাকি দুই সন্তানকে গ্রাম থেকে আনা হয়। শুনানি শুরু হয়। বাচ্চাদের থেকে জানতে চাওয়া হয়, তারা কোথায় থাকতে চায়? বাচ্চারা প্রত্যেকেই বাবার কাছে থাকার কথা জানিয়ে দেয়। শুনানির শেষে চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কমিটির চেয়ারপার্সন শ্রীমতি অমৃতা ঘোষ তিনজনকে বাবার কাস্টডিতে, এবং কনিষ্ঠ সন্তান মোহাঃ জায়েদ আফজালকে মায়ের কাস্টডিতে তুলে দেন। জায়েদ বাবার কাছে যেতে চাইলেও ছোট হওয়ার কারণে অমৃতাদেবী আপাতত মায়ের কাছে পাঠান।
বাচ্চারা মায়ের কাছে থাকতে চায়নাঃ
ছোটো ছোটো সন্তানরা তো মায়ের কাছেই থাকতে বেশী পছন্দ করে। কিন্তু ইশরাত জাহানের বাচ্চারা ব্যতিক্রম কেন? কেন তারা আপন মাকে ছেড়ে বাবা এবং সৎ মায়ের কাছে থাকতে চাইছে? এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার জন্য আমি বিহার থেকে মোর্তজা আনসারী এবং তাঁর তিন সন্তানকে কোলকাতা ডেকে পাঠাই। বাচ্চাদের সাথে কথা বলার জন্য পাঁচজনের একটি টিম গঠন করি। এই টিমে ছিলেন- একজন অমুসলিম বিজ্ঞানী, একজন স্কলার এবং নারী অধিকার আন্দোলনের কর্মী, একজন এমডি ডাক্তার, একজন আইনবিদ এবং আমি। মোস্তফা, মোর্তজা এবং চাচার ছেলে সাথে বাচ্চারা আমার কাছে উপস্থিত হন। বড়দের বের করে দিয়ে আলাদাভাবে বাচ্চাদের সাথে কথা বলি। আমরা জানতে পারি, ইশরাত জাহান তাঁর বাচ্চাদের উপর খুবই অত্যাচার করতেন। প্রেমিক আফজালের কথা যাতে বাচ্চারা কাউকে না জানিয়ে দেয়, সেজন্য ভয়ভীতি প্রদর্শন থেকে মারধোর করতেন। বড় মেয়ের গলায় একাধিকবার ছুরি পর্যন্ত ধরেছেন। ছোট মেয়েকে জ্বলন্ত ধুপকাঠির ছ্যাঁক দেওয়া হয়েছে। বিভিন্নভাবে জানতে চাওয়ার পরে আমদের প্রত্যেকের মনে হয়েছে, বাচ্চারা শিখিয়ে দেওয়া নয়, সত্যি কথাই বলছে।
মোর্তজা আনসারী বাচ্চাদের নিয়ে হাওড়ার এক বন্ধুর ফ্ল্যাটে উঠেছেন। নিজের ফ্ল্যাটে উঠতে পারেননি।
ফ্ল্যাট দখলঃ সুপ্রিমকোর্টের রায়ের পরে আমার যে বন্ধু এবং রাজনৈতিক নেতা আমায় ফোন করে বলেছিলেন, ইশরাত জাহানকে হুমকি দেওয়া হচ্ছে, তাঁর থেকেই জানতে চেয়েছিলাম- ইশরাত জাহান এখন থাকছেন কোথায়? তিনি বলতে পারেননি। আমি সেই আপার থেকে জানতে চেয়েছিলাম। তিনিও হাওড়ার এক জায়গায় আছে বলে ছেড়ে দিয়েছিলেন। পরে জানতে পারি, ইশরাত জাহান আজ অবধি স্বামীর ফ্ল্যাটেই রয়েছেন, যে ফ্ল্যাটে স্বামী তাঁর বাচ্চাদের নিয়ে যেতে পারেন না। আমার মনে প্রশ্ন দানা বাঁধে, ইশরাতকে বড়বড় নেতারা নাকি হুমকি দিয়েছেন, তিনি ভয়ানক অত্যাচারিত-এরপরেও তিনি স্বামীর ফ্ল্যাট দখল করে রয়েছেন? স্বামী ফ্ল্যাটে উঠতে পারেন না? গ্রামের বাড়ি থেকে এসে বন্ধুর বাড়িতে থাকতে হয়? কিভাবে সম্ভব? সবই গোলমেলে...
পরিশেষে বলতে চাই, আমি মনে করি, শুধু মুসলিম কেন? পুরুষতান্ত্রিক সমাজে অধিকাংশ নারীই বঞ্চিত, অত্যাচারিত। আমাদের সকলেরই উচিত নারী অধিকারের পক্ষে কথা বলা, তাদের ন্যায্য দাবী সমর্থন করা। ব্যক্তিগতভাবে আমি সেই মানসিকতা থেকেই প্রাথমিকভাবে ইশরাত জাহানের পাশে আর্থিক এবং সামাজিকভাবে দাঁড়াতে চেয়েছিলাম। সেই সুযোগ পাইনি। দেওয়া হয়নি। এর অর্থ এই যে, মিথ্যা ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে থাকা আন্দোলনকে সমর্থন করতাম! আগে বুঝে নিতাম।
আমি এও মনে করি, ইশরাত নিজেও ভিক্টিম। তিনি রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের ভিক্টিম। বারবার বলেছি, আবার বলছি, ইনস্ট্যান্ট তিন তালাক জঘন্য। কিন্তু মিথ্যার উপর ভিত্তি করে ইনস্ট্যান্ট তিন তালাকের নামে মুসলিম মহিলাদের মুক্তি এবং অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার মিথ্যা দাবী সম্প্রচার আরও বেশি কদর্য। মহিলাদের অধিকার আদায়ের পক্ষেই রয়েছি। তবে মিথ্যার উপর ভিত্তি করে নয়। রয়েছি সত্যের সাথে, সাহসের সাথে।
আরেকটি বিষয়, লেখাটির মধ্যে কোথাও ব্যক্তি আক্রমণের প্রচেষ্টা করিনি। আমি বিশ্বাস করি, ব্যক্তি আক্রমণ তথ্যপ্রমাণ এবং যুক্তিকে দুর্বল করে দেয়। যেহেতু বিষয়ের মূলে রয়েছে ব্যক্তিগত সম্পর্ক, তাই প্রয়োজনের তাগিদে স্বাভাবিকভাবেই কিছু ব্যক্তিগত বিষয় আলোচনা করেছি। অবশ্যই ব্যক্তি কুৎসার জন্য নয়, বিষয়টি ঠিকঠাক বুঝে নেওয়ার জন্য।
ইশরাত জাহান বিজেপিতে যুক্ত হয়েছেন, খবরটি আগের রাতেই নিউজ চ্যানেলের মাধ্যমে শুনেছিলাম। পরেরদিন সকালে সর্বভারতীয় ইংরেজি পত্রিকা দ্য হিন্দুতে খবরটি পড়ার সময় শেষ অনুচ্ছেদে বাংলা বিজেপি নেত্রী লকেট চ্যাটার্জীর বক্তব্যে চোখে আটকে যায়।
“We have been collaborating with her and providing her legal assistance in her battle against triple talaq for a long time. It would be wrong to assume that her move join BJP was a sudden decision”
অর্থাৎ “তিন তালাকের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য আমরা দীর্ঘদিন ধরেই তাকে আইনি সাহায্য করে আসছিলাম। তিনি বিজেপিতে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হঠাৎ করে নিয়েছেন এমন ভাবাটা ভুল।“
বিজেপি দীর্ঘদিন ধরেই ইশরাত জাহানকে আইনি সাহায্য করে আসছে! ইশরাত জাহান দীর্ঘদিন ধরেই বিজেপির আশ্রয়ে রয়েছেন! হতচকিত হলাম এবং ফিরে গেলাম ফ্ল্যাশব্যাকে।
গতবছর অর্থাৎ ২০১৭ সালের ২২শে আগস্ট ভারতের সুপ্রিমকোর্টের পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চের ৩:২ রায়ে, তালাক ই বিদ্দাত অর্থাৎ ইনস্ট্যান্ট তিন তালাক অবৈধ ঘোষিত হওয়ার সাথেসাথেই সংবাদমাধ্যম এবং বিজেপি নেতানেত্রীরা আনন্দে উৎসবে ফেটে পড়েন। রায় প্রকাশের দুএকদিন পরেই একটি রাজনৈতিক দলের রাজ্যস্তরের নেতা আমায় ফোন করে জানান, ইশরাত জাহানকে নানানভাবে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। বর্তমানে ইশরাত জাহান আর্থিক সমস্যায় ভুগছেন। উল্লেখ্য, সেই নেতা আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ইশরাতকে হুমকি দেওয়া হচ্ছে, একথা শোনার পরে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হই। বিভিন্ন মুসলিম সংগঠনের নেতানেত্রীদের ফোন করে ইশরাত জাহানের পাশে দাঁড়ানোর আবেদন জানাই। এমনকি, বিষয়টি নিয়ে নিজের পরিবারের সাথেও বাকযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ি। দাদা এবং আম্মাজীর বক্তব্য ছিল, মুসলিম নেতারা ইশরাত জাহানের পাশে থাকেননি এটা অন্যায়। কিন্তু তিনি কি মুসলিম নেতাদের কাছে গিয়েছিলেন?
সেসময়ে মুসলিম নেতা থেকে শুরু করে নিজের পরিবারের সদস্যের বক্তব্যগুলি আমার কাছে নেহাতই অজুহাত ছাড়া আর অন্যকিছু মনে হয়নি। এরপর, ইশরাত জাহানের ফোন নম্বর জোগাড় করে আমি নিজেই তাঁর সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করি। জানাই, সামাজিক এবং আর্থিকভাবে তাঁর পাশে থাকতে চাই। কিন্তু তিনি আমার সাথে কথা বলতে রাজি হননি। তাঁর আইনজীবী নাজিয়া ইলাহী খান- এঁর সাথে কথা বলতে বলা হয়। যোগাযোগ করে উঠতে পারিনি। বেগতিক দেখে, নারী ও আদিবাসীদের আর্থসামাজিক আন্দোনলের সাথে যুক্ত এক আপার সাথে কথা বলি এবং ইশরাত জাহানের সাথে যোগাযোগ করে দেওয়ার অনুরোধ করি। তিনিও ব্যর্থ হন। এরপর আমি নিজেও চুপ করে যাই। তারপর সাম্প্রতিক দ্য হিন্দু পত্রিকায় লকেট চ্যাটার্জীর বিবৃতি এবং সেই বিবৃতির পরিপ্রেক্ষিতে শুরু হয় আমার ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং।
হাওড়ার মেয়ে ইশরাত জাহানঃ
ইনস্ট্যান্ট তিন তালাক নিয়ে সুপ্রিমকোর্টের রায়ের সময় সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত হয়, ইনস্ট্যান্ট তিন তালাক মামলায় যে পাঁচজন পিটিশনার ছিলেন তাঁদের অন্যতম আমাদের বাংলা তথা হাওড়ার মেয়ে ইশরাত জাহান। শোনার পরে বেশ আনন্দই হয়েছিল। বাহ, আমাদের বাংলার মেয়েও রয়েছেন যিনি এমন একটি ঐতিহাসিক লড়াইয়ের সেনাপতি! কিন্তু ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং-এর পরে আমার সেই আনন্দ একেবারেই বিলীন হয়ে যায়। ইশরাত জাহান বাংলা লিখতে, পড়তে, বলতে, এমনকি বুঝতেও পারেন না। বাংলার মেয়ের পক্ষে এটা কীভাবে সম্ভব! সত্যি কথা বলতে, ইশরাত বাংলার মেয়েই নয়। ইশরাতের বাবার বাড়ি বিহারের নওদা জেলার পকরী বরাওয়া গ্রামে। বাবা মোহাঃ হাসিব পেশায় দর্জি। তিনি সেখানেই পড়াশুনা করেন এবং বিহার বোর্ড থেকে মাধ্যমিক উত্তীর্ণ হন। মাধ্যমিক পাশের পরে ২০০১ সালে ইশরাতের বিয়ে হয় বিহারের অরঙ্গাবাদ জেলার ইটাওয়া নিবাসী মোহাঃ মোর্তজা আনসারীর সাথে। ইশরাতের স্বামী মোর্তজাও বিহার বোর্ড থেকেই মাধ্যমিক পাশ করেন। অর্থাৎ বাবা এবং শ্বশুরবাড়ি- কোনোদিক থেকেই ইশরাত বাংলার নয়, বিহারের মেয়ে। এখন প্রশ্ন হল, তথ্য গোপন করে ইশরাতকে বাংলার মেয়ে ব’লে ব্যাপক প্রচারের পেছনে সংবাদমাধ্যমের আসল উদ্দেশ্য কি? ইশরাতের সপক্ষে বাঙালি জাতীয়তাবোধ চাগিয়ে তোলা!
ইশরাত জাহানের হাওড়ায় আগমনঃ
২০০১ সালে বিয়ের পরে ইশরাত শ্বশুর বাড়িতে স্বামীর সাথে সংসার শুরু করেন। একসাথে ছয়মাস থাকার পরে রোজগারের তাগিদে স্বামী মোর্তজা তাঁর স্ত্রী ইশরাতকে মায়ের কাছে রেখে পুনরায় দুবাই পাড়ি দেন। ২০০৩ সালে ইশরাত জাহানের শাশুড়ি হার্ট অ্যাটাকে মারা যান। এরপর মোর্তজা তাঁর গর্ভবতী স্ত্রীকে হাওড়ার লিলুয়ার ফ্ল্যাটে দাদা-ভাবীর কাছে রেখে দুবাই পাড়ি দেন। উল্লেখ্য, মোর্তজা আনসারীর দাদা মোস্তফা আনসারী পেশায় প্রাইমারী স্কুল শিক্ষক। ফ্ল্যাটটি দুই ভাইয়ের নামেই রয়েছে।
ইশরাত জাহানের হাওড়া-বিহারঃ
ভাসুরের সংসারে থাকার কিছুদিন পর থেকেই ইশরাত জাহানের সাথে তার জা-এর সাংসারিক ঝামেলা শুরু হয়। সাংসারিক সমস্যার জন্য ইশরাত এবং মোর্তজা প্রায় দীর্ঘ সাতবছর মোস্তফা ও তার স্ত্রীর সাথে কথা বন্ধ করে দেন। এরপর থেকে বেশিরভাগ সময়েই ইশরাত থাকতেন বিহারে তাঁর শ্বশুরবাড়িতে। যখন যখন মোর্তজা দুবাই থেকে ফিরতেন, তখন তখন কিছুদিন হাওড়ায় স্ত্রীকে নিয়ে থাকতেন। দুবাই যাওয়ার সময় আবার স্ত্রীকে বিহারে রেখে চলে যেতেন। অর্থাৎ দাম্পত্য জীবনের আগে পুরোটাই এবং পরে বেশিরভাগ সময় ইশরাত বিহারে থেকেছেন। তবে, ২০১৩ সাল থেকে ইশরাত বাচ্চাদের গ্রামের বাড়িতে রেখে মাঝেমাঝেই হাওড়ায় এসে থাকতেন।
ইশরাত জাহানের সাথে স্বামী মোর্তজার ঝামেলাঃ
ইশরাতের সাথে তাঁর স্বামীর ঝামেলা শুরু হয় মূলত ২০১৩ সাল থেকে। ঝামেলার কারণ, ইশরাত হাওড়ার ফ্ল্যাটে থাকতে চেয়েছিলেন। কিন্তু স্বামী বলেছিলেন, বিহারে গ্রামের বাড়িতে থাকতে। প্রশ্ন হল, স্বামী তো থাকেন দুবাইতে। ইচ্ছানুসারে ইশরাত যদি হাওড়াতেই থাকেন তাহলে সমস্যা কোথায়? ইশরাতের স্বামী মোর্তজার বক্তব্য অনুযায়ী, “কয়েকজনের থেকে খবর পাই, হাওড়ায় থাকাকালীন ইশরাত বাচ্চাদের বাড়িতে রেখে সকালে বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাতে ফিরতেন। অনেক সময় বাড়ি ফিরতে রাত বারোটা বেজে যেতো।“ এরপর মোর্তজা অভিযোগ করেন, “ সময়টা ২০১৪ সাল।একদিন দুবাই থেকে দুপুরবেলা ফোন করেছিলাম। পাশ থেকে একজন ব্যক্তিকে চাপা সুরে বলতে শুনি, কোন ফোন কিয়া রে? ইশরাত চাপা গলায় উত্তর দেয়, পাগলা ফোন কিয়া। একথা শুনে আমি অল্প জামাকাপড় নিয়ে চড়া দামে এয়ারপোর্ট থেকে টিকিট কিনে সরাসরি কোলকাতায় ফিরে আসি। ফিরেই ঝামেলা শুরু হয়। স্ত্রীর সাথে ঝামেলা হাতাহাতির পর্যায়ে পৌঁছে যায়। বাচ্চাদের নিয়ে চলে যাই বিহারে গ্রামের বাড়িতে। এনিয়ে ইশরাত আমার বিরুদ্ধে হাওড়ার গোলাবাড়ি থানায় আইপিসি 498(A)তে এফ আই আর করে। কেস নম্বর- ১০৮৫/২০১৪, তারিখ ২৪/১০/২০১৪। অবশ্য একমাস পরে অর্থাৎ ২৪/১১/২০১৪তে ইশরাত নিজেই হাওড়াকোর্ট থেকে আমার জামিন করিয়ে নেয়। বাচ্চাদের নিয়ে আমি আবার হাওড়ার ফ্ল্যাটে ফিরে আসি। কোর্টের আদেশ অনুসারে আমরা আবার হাওড়ার ফ্ল্যাটে একসাথে থাকতে শুরু করি।“ বলে রাখা ভালো, কেস এবং জামিনের সমস্ত কপিই আমার কাছে রয়েছে।
ইশরাত জাহানের বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কঃ
মোর্তজা আনসারী অভিযোগ করেন, “জামিনের কয়েকদিন পরেই ০৩/১২/২০১৪ তারিখে ইশরাত একটি চিঠি লিখে বাচ্চাদের বাড়িতে রেখে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যান।“ উল্লেখ্য, তিন পাতার চিঠির কপিটি আমার কাছে রয়েছে। চিঠিটি ইশরাতেরই লেখা কিনা তা যাচাই করার জন্য আমি ইশরাতের একাধিক লেখাপত্র জোগাড় করি। এবং নিশ্চিত হই, চিঠিটি ইশরাতেরই লেখা। ০৪/১২/২০১৪ তারিখে হাওড়ার গোলাবাড়ি থানায় মোর্তজা একটি নিখোঁজ ডায়েরী করেন। সেই ডায়েরীর কপিটিও সংগ্রহ করেছি। অবশ্য নিখোঁজের দুদিন পরেই এক আত্মীয়ের বাড়ি থেকে ইশরাতকে ফিরিয়ে নিয়ে আসা হয়। চিঠিটিতে ইশরাত বলেন,” আমি তোমার সাথে আর প্রতারণা করতে পারবো না। বাড়ি ছেড়ে চলে গেলাম। তুমি তালাকনামা তৈরি রেখো। আমি সময় করে নিয়ে যাবো।“
মোর্তজা দাবী করেছেন, “আমার স্ত্রীর সাথে তার গ্রামেরই আফজাল ওরফে রাজু নামের একটি ছেলের সাথে প্রেমের সম্পর্ক ছিল। এখবরটি আমি বাচ্চাদের থেকে জানতে পারি। বাচ্চারা আমায় জানায়, বিভিন্ন সময়ে মা এবং রাজুমামা ঘুরতে বেরিয়ে যেত।“ মোর্তজা আনসারী অভিযোগ করেছেন, ২০০৯ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত ইশরাত চারবারেরও বেশি ছোটবেলার প্রেমিক আফজাল ওরফে রাজুর সাথে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছেন।
রামপুরহাটে ইশরাত জাহানঃ
মোর্তজা দাবী করেছেন, ২০১৩-১৪সালে ইশরাত জাহান তার বাচ্চাদের নিয়ে রাজুর সাথে বীরভূম জেলার রামপুরহাট গিয়েছিলেন এবং একমাসেরও বেশি একসাথে ছিলেন। রামপুরহাটে তিনি অমরজিত দে নামক এক ব্যক্তির শ্বশুরবাড়িতে ছিলেন। এই তথ্যটি যাচাই করার জন্য আমি অমরজিতবাবুর সাথে যোগাযোগ করি। তিনি ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, আমার স্ত্রীর ক্যান্সার হয়েছিল। চিকিৎসা করাতে কোলকাতা গিয়েছিলাম। সেই সূত্রে আমার সাথে ইশরাত জাহানের পরিচয়। কোলকাতা গেলে আমরা ইশরাতের ফ্ল্যাটেই থাকতাম, খেতাম। আমাদের মধ্যে গভীর আত্মীয়তার সম্পর্ক গড়ে ওঠে।“ ইশরাতের সাথে আফজালের রামপুরহাটে একসাথে থাকার প্রসঙ্গে বলেন, “ ইশরাত আফজালকে নিজের ভাই পরিচয় দিয়ে এখানে তিনি ছিলেন।“ এছাড়া রামপুরহাটের আরও দুজনের থেকে ঘটনার সত্যতা যাচাই করেছি।
ইশরাত জাহানের অন্তর্ধানঃ
আগেই উল্লেখ করেছি, পিএস কেস নম্বর- ১০৮৫/২০১৪, আনডার সেকশন ৪৯৮/৪০৬/আইপিসি ৩/৪ ডিপি এক্ট-এর ভিত্তিতে হাওড়া কোর্ট স্বামী এবং স্ত্রী ইশরাত জাহানকে একসাথে থাকার নির্দেশ দেয়। তাঁরা একসাথে থাকতে শুরুও করেন। কয়েকদিন পরে ইশরাত জাহান স্বামীর থেকে তালাক চেয়ে চিঠি লিখে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান। এই মর্মে মোর্তজা আনসারী গোলাবাড়ি থানায় একটি নিখোঁজ ডায়েরী করেন। দুদিন পরে এক আত্মীয়ের বাড়ি থেকে ইশরাতকে ফিরিয়ে নিয়ে আসা হয়। একসাথে থাকতে শুরু করলেও সংসারে আর শান্তি ফিরে আসেনি। ২০১৫ সালের জানুয়ারী মাসের প্রথম সপ্তাহে ইশরাত জাহান এবং মোর্তজার মারামারি হয়। মোর্তজা চার সন্তানকে নিয়ে বিহারের গ্রামের বাড়িতে ফিরে যান। ইশরাত রয়ে যান হাওড়াতেই। কয়েকদিন পরে, ২০১৫-এর জানুয়ারী মাসের মাঝামাঝি সময়ে, ইশরাত জাহানও বিহারের শ্বশুরবাড়িতে পৌঁছান। চারদিন পরেই মোর্তজার দুবাই রওনা হওয়ার কথা। কোলকাতায় থাকা নিয়ে সেখানে ইশরাত এবং মোর্তজার মারামারি হয়। সেই মারমারিতে মোর্তজার মাথা ফেটে যায়। মোর্তজা স্ত্রীর নামে হাসপুরা থানায় ডায়েরী করতে গেলে, থানা স্বামী-স্ত্রীর ঝামেলা নিজেদের মধ্যেই মিটমাট করে নিতে বলে। মাথায় ব্যান্ডেজ নিয়েই মোর্তজা দুবাই রওনা দেন।
এরপর, ইশরাত বাচ্চাদের সাথে নিয়ে কয়েকদিন শ্বশুরবাড়িতে থাকেন। কিন্তু, ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারী মাসের ১০ তারিখে ছয় বছরের বাচ্চা থেকে শুরু করে এগারো বছর বয়স পর্যন্ত চারজন সন্তানকে বাড়িতে রেখে চলে যান। এরপরে আর তিনি গ্রামের শ্বশুর বাড়িতে ফেরেননি।
সন্তানসন্ততি এবং তাদের দেখাশনাঃ
ইশরাত এবং মোর্তজার চারজন সন্তানের মধ্যে, ২০১৫ সাল অনুযায়ী, ১১ বছর বয়সী সায়িস্তা খাতুন, ৯ বছর বয়সী কাহকাশা খাতুন, ৮ বছর বয়সী বুশরা খাতুন এবং ৬ বছর বয়সী মোহাঃ জায়েদ আফজাল রয়েছে। উল্লেখ্য, কনিষ্ঠ পুত্র সন্তান মোহাঃ জায়েদ ‘আফজাল’-এর নামকরণ করেন ইশরাত জাহান নিজেই। বাচ্চাদের বাড়িতে ছেড়ে চলে যাওয়ার পরে, মোর্তজা আনসারীর অনুরোধে তাঁরই এক দিদি তাদের দেখাশনার দায়িত্ব নেন। মোর্তজা আনসারী সেই বয়স্কা দিদিকে টাকা পাঠিয়ে দিতেন। বাচ্চাদের তিনি গ্রামের স্কুলেই ভর্তি করে দেন। জায়েদ আফজাল বাদে আজ অব্ধি প্রতিটি বাচ্চাই গ্রামের স্কুলে পড়াশুনা করে।
ইশরাত জাহানের অন্তর্ধান বিষয়ে থানা এবং কোর্টে রিপোর্টঃ
কয়েকমাস পরে, মোর্তজা আনসারী দুবাই থেকে ফিরে আসেন। দুবাই থেকে ফিরে ২৪শে সেপ্টেম্বর ২০১৫ তারিখে স্থানীয় হাসপুরা থানায় একটি নিখোঁজ ডায়েরী করেন। ডায়েরীর কপিটি আমি সংগ্রহ করেছি। কপিতে থনার কোনও শিলমোহর নেই। থানা থেকে শিলমোহর দেওয়া হয়নি। থানা থেকে শিলমোহর না দেওয়ায় মোর্তজা আনসারী দাউদনগর কোর্টে গিয়ে একটি এফিডেবিট জমা দেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে কোর্ট থেকে হাসপুরা থানায় একটি নোটিশ পাঠানো হয়। নোটিশ নম্বর- ১৬৩৩/২০১৫। কোর্ট থেকে পাঠানো নোটিশের জেরক্স কপিটি আমার সংগ্রহে রয়েছে।
মোর্তজা আনসারীর দ্বিতীয় বিয়েঃ
ছোটছোট চার সন্তানের বিষয়টি মাথায় রেখে গ্রামের বিশিষ্ট লোকদের নিয়ে একটি আলোচনা সভা হয়। সেখানে মোর্তজা আনসারীকে দ্বিতীয় বিয়ের পরামর্শ দেওয়া হয়। বাচ্চাদের কথা চিন্তা করে দ্বিতীয় বিয়েতে তিনি সম্মতিও জানান। বিয়ে ঠিক হয় বাড়ি থেকে তিনঘন্টা দূরত্বে বিহার-ঝাড়খন্ড বর্ডারে অবস্থিত হরিহরগঞ্জ নামে একটি এলাকার এক বিধবা মহিলার সাথে। কন্যাপক্ষের কাছে সমস্ত বিষয় আগে থেকেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল। মোর্তজা আনসারী পাঁচজন ব্যক্তিকে নিয়ে বিয়ের জন্য রওনা হন। কিন্তু বিয়ের দিনে, ইশরাত হরিগঞ্জ থানার কয়েকজন পুলিশকে সাথে নিয়ে কন্যাপক্ষের বাড়িতে পৌঁছে যান। বিয়ের আগেই, পুলিশ সকলকে থনায় তুলে নিয়ে যায়।
এরপর মোর্তজার গ্রামের লোকদের খবর দেওয়া হয়। গ্রামের মুখিয়া(প্রধান)সহ অনেকেই থানাতে আসেন। পুলিশের সামনে ঘটনাগুলি জানানো হয়, এবং তার ভিত্তিতে কাগজপত্র দেখানো হয়। মোর্তজার কাছে জানতে চাওয়া হয়, তিনি কি চাইছেন? মোর্তজা বলেন, “বিয়ে তো আমি সাধ করে করছি না, বাধ্য হয়ে করছি। ইশরাত যদি আমার সাথে থাকতে চায়, তাহলে আমার দ্বিতীয় বিয়ের দরকার নেই । তবে ইশরাতকে কোলকাতায় নয়, গ্রামের বাড়িতে থাকতে হবে। কারণ, আমার বাচ্চারা সকলে গ্রামের স্কুলে পড়াশুনা করে। আমাদের ঝামেলার কারণে বাচ্চাদের এমনিতেই পড়াশুনার বহু ক্ষতি হয়ে গেছে। আর নয়।“ এরপর থানা থেকে মোর্তজাকে বলা হয়, “আপনি যদি গ্রামের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে স্ত্রীর উপর অত্যাচার করেন?” মোর্তজা বলেন, “স্যর এবিষয়ে কাগজপত্র থানা থেকেই তৈরি করে দিন। আমি সাক্ষর করতে রাজী রয়েছি।“ কিন্তু, এই প্রস্তাবে ইশরাত জাহান রাজী হননি। থানা থেকে তিনি বেরিয়ে যান। থানাপুলিশের চক্করে হরিহরগঞ্জের সম্বন্ধটিও ভেঙে যায়।
ঘটনার কয়রকদিম পরে, বিহারের জাহানাবাদ জেলার প্রায় ত্রিশ বছর বয়সী তালাকপ্রাপ্তা সাবানা নামের এক মহিলার সাথে মোর্তজার বিয়ে হয়। বিয়ের শর্ত ছিল, মোর্তজা বাচ্চাদের দেখাশনার জন্য বিয়ে করছেন। এবিষয়ে কোর্টে কাগজও বানানো হয়। দ্বিতীয় স্ত্রীর সন্তান জন্ম নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে মোর্তজা বলেন, “ আমি বিয়ে করেছি বাচ্চাদের দেখাশোনার জন্য। কোর্টে কাগজও বানিয়েছি। নতুন স্ত্রীর থেকে বাচ্চা নেওয়ার প্রশ্নই ওঠেনা।“ মোর্তজার দ্বিতীয় স্ত্রীই এখন বাচ্চাদের দেখাশোনা শুরু করেন।
মোর্তজার বিরুদ্ধে হাওড়া কোর্টে ইশরাত জাহানের ক্রিমিনাল কেসঃ
ইতিমধ্যে, ইশরাত জাহান হাওড়ায় ফিরে আসেন। এবং হাওড়া ক্রিমিনাল কোর্টে মোর্তজা আনসারী, মোর্তজা আনসারীর দাদা মোস্তফা আনসারী এবং মোস্তফা আনসারীর স্ত্রী জাবীনা খাতুনের বিরুদ্ধে পণ ও নির্যাতনের জন্য মামলা দায়ের করেন। মিসলেনিয়াস কেস নম্বর-৭২১/২০১৫, তারিখ-১৪/১০/২০১৫। কোর্টে এফিডেবিট দাখিল করে ইশরাত জানান,
তাঁর স্বামী মোর্তজা আনসারী এবং অন্য দুই অভিযুক্ত শারীরিক এবং মানসিক অত্যাচার করে। এই অত্যাচার করা হয়েছিল তাঁর বাবার থেকে পণ আদায়ের জন্য। বিয়ের সময়, এখন যে ফ্ল্যাটে থাকেন সেই ফ্ল্যাটটি কেনার জন্য বাবার থেকে পণ হিসেবে পাঁচ লক্ষ টাকা দাবী করা হয়। বর্তমানে অতিরিক্ত দুই লক্ষ টাকার জন্য অত্যাচার করা হচ্ছে। এরসাথে কোর্টের কাছে ইশরাত আবেদন করেন, দোষীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থাসহ মামলার খরচ পঞ্চাশ হাজার টাকা এবং চিকিৎসা খরচ পাঁচ হাজার টাকা আদায় এবং দুই লক্ষ টাকা জরিমানা হিসেবে আদায় করে দেওয়া হোক।
উক্ত ক্রিমিনাল কেসটির নিষ্পত্তি হয় গত ২০১৭ সালের ১৮ই মার্চ। হাওড়া ক্রিমিনাল ৫নম্বর কোর্টের ফার্স্টক্লাস জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ইশরাত জাহানের দায়ের করা মামলাটি খারিজ করে দেন।
মোস্তফা আনসারীর বিরুদ্ধে গোলাবাড়ি থানায় এফ আই আরঃ
২০১৫ সালের ডিসেম্বর মাসের ২৮ তারিখে, ইশরাত জাহান তাঁর ভাসুর মোস্তফা আনসারীর বিরুদ্ধে এফ আই আর করেন। এফ আই আর নম্বর-১৫৩৩, সেকশন-৩৪১/৩২৩/৩৫৪/৫০২। এফ আই আর-এর সাক্ষী হিসেবে প্রতিবেশী জসিম খান এবং তাঁর স্ত্রী সনি বেগমের নাম রাখা হয়। এফ আই আর এবং সাক্ষীদের বয়ান অনুযায়ী, ০২/১২/২০১৫ তারিখে ভাসুর মোস্তফা আনসারী বেলা ১১টার সময় শ্লীলতাহানি করেন এবং প্রচন্ড মারধোর করেন। কিন্তু, প্রাইমারী স্কুল শিক্ষক মোস্তফা আনসারীর এটেনডেন্স রেজিস্টার থেকে দেখা যায়, ঘটনার দিন তিনি ১০টা বেজে ৪০ মিনিটে সই করেছেন। ফ্ল্যাট থেকে স্কুলের দূরত্ব প্রায় ১৫ কিলোমিটার। দ্বিতীয়ত, সাক্ষী সনি বেগমের সাথে আমি নিজে যোগাযোগ করি। তিনি জানান, তাঁরা এরকম কোনও সাক্ষী দেননি। পুলিশ তাদের কিছু জিজ্ঞেস করেনি। মামলাটি এখন বিচারাধীন।
ইনস্ট্যান তিন তালাকের বিরুদ্ধে ইশরাত জাহানের পিটিশন দাখিলঃ
সুপ্রিমকোর্টে এক হিন্দু মহিলার মামলার শুনানি চলছিল। মহিলা অভিযোগ করেন, তাঁর স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন। কোর্ট সেই মহিলাকেই স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ের বিষয়টি প্রমাণ করতে বলে। হিন্দু বিবাহ আইন অনুযায়ী, কন্যাদান পদ্ধতিতে বিয়ে না করলে সেই বিয়ে বৈধ হয়না। স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে কন্যাদান পদ্ধতি করেননি, তাই সুপ্রিমকোর্ট আইনি বাধ্যবাধকতার কথা জানিয়ে মামলাটি খারিজ করে দেয়। একই মামলার রায়দানের সময়, ২০১৬ সালের ২৯শে ফেব্রুয়ারী, বিচারক অনিল দাভে এবং এ,কে গোয়েল তাদের রায়ের অবজার্ভেশনে মুসলিম সম্প্রদায়ের ইনস্ট্যান্ট তিন তালাক নিয়ে প্রশ্ন তোলেন এবং নোটিশ ইস্যু করেন। হিন্দু বিবাহ আইনি জটিলতার কারণে হিন্দু মহিলা ন্যায় বিচার পেলেন না, কিন্তু অযাচিতভাবে একই রায়ে সুপ্রিমকোর্ট ইনস্ট্যান্ট তিন তালাকের বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। এবিতর্ক অবশ্য ভিন্ন। যাইহোক, সুপ্রিমকর্টের নোটিশের ভিত্তিতে ইশরাত জাহানের পিটিশনটি দাখিল করা হয় ২০১৬ সালের আগস্ট মাসের ১২ তারিখে। অর্থাৎ সুপ্রিমকোর্টের নোটিশ জারী এবং সেনিয়ে মিডিয়া ট্রায়াল ও সরকারের অবস্থানে প্রায় সাড়ে পাঁচ মাস পরে ইশরাত জাহানের আইনজীবী ভিকে বিজু এবং নাজিয়া ইলাহী খান পিটিশন দাখিল করেন। পিটিশনটি তৈরি করেন মূলত আইনজীবী ভিকে বিজু। সহকারী হিসেবে ছিলেন নাজিয়া এলাহী খান। অনেক বক্তব্যের সাথে ৩৪ পাতার পিটিশনে বলা হয়, মোহাঃ মোর্তজা আনসারী ভিক্টিম ইশরাত জাহানকে ২০১৫ সালের এপ্রিল মাসে দুবাই থেকে ফোনের মাধ্যমে তালাক তালাক তালাক উচ্চারণে ইনস্ট্যান্ট তিন তালাক দেন এবং ফোনটি কেটে দেন।
ইনস্ট্যান্ট তিন তালাক নিয়ে মোর্তজার বক্তব্যঃ
ইশরাত জাহান তাঁর পিটিশনে দাবী করেছেন, ২০১৫ সালের এপ্রিল মাসে তাঁর স্বামী মোর্তজা আনসারী তাঁকে ফোনের মাধ্যমে ইনস্ট্যান্ট তিন তালাক দেন। কিন্তু মোর্তজা আনসারী সেই অভিযোগ প্রথম থেকেই অস্বীকার করে আসছেন। রায়ের আগে, ইনস্ট্যান্ট তিন তালাকের শুনানি নিয়ে যখন সারা দেশ এবং মিডিয়া তোলপাড়, সেই সময় দাদা মোস্তফার থেকে ফোন নম্বর জোগাড় করে একটি সর্বভারতীয় ইংরেজী নিউজ চ্যানেল মোর্তজাকে ফোনও করে এবং তালাক দেওয়ার বিষয়টি জানতে চায়। মোর্তজা পরিষ্কার জানিয়ে দেন, তিনি তালাক দেননি। এরপরেও সব সময়েই তিনি বলে এসেছেন, তিনি ইশরাত জাহানকে তালাক দেননি।
ইনস্ট্যান্ট তিন তালাকের আসল রহস্যঃ
একদিকে ইশরাত জাহান বলছেন, ফোনে তাঁর স্বামী তাকে তালাক দিয়েছেন। অন্যদিকে, মোর্তজা বলছেন, তিনি আজ অব্ধি তালাক দেননি। কার কথা সত্য?
এবিষয়ে আমি নিজে নথিপত্রগুলি যাচাই শুরু করি। মোর্তজা আনসারী গোলাবাড়ি থানা, হাসপুরা থানা, হাওড়া কোর্ট এবং শেষ ২০১৫ সালের ২৯শে ডিসেম্বর বিহারের দাউদপুর কোর্টে যে ইনফর্মেশন এফিডেবিট দাখিল করেন, সেখানে কোথাও তিনি ইশরাত জাহানকে প্রাক্তন স্ত্রী বলে উল্লেখ করেননি। বরং প্রতিটি স্থানেই তিনি ইশরাতকে বর্তমান স্ত্রী বলেই উল্লেখ করেছেন। প্রশ্ন হল, তিনি যদি সত্যিই ২০১৫ সালের এপ্রিল মাসে ইনস্ট্যান্ট তিন তালাক দিয়ে থাকেন, তাহলে আট-নয় মাস পরে ২০১৫ সালের ২৪শে ডিসেম্বর হাসপুরা থানায় নিখোঁজ ডায়রী কিংবা ২৯শে ডিসেম্বর দাউদপুর কোর্টে ইশরাতের নিখোঁজ ইনফর্মেশন দেওয়ার সময় ইশরাত জাহানকে তালাকপ্রাপ্ত প্রাক্তন স্ত্রী উল্লেখ না করে বর্তমান স্ত্রী হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন কেন? তখন তো সুপ্রিমকোর্ট থেকে ইনস্ট্যান্ট তিন তালাক অসাংবিধানিক ঘোষিত হয়নি। এনিয়ে মিডিয়া ট্রায়ালও শুরু হয়নি। দ্বিতীয়ত, মোর্তজা শুরু থেকে আজ অব্ধি ইশরাতের সাথে সংসার করতে রাজী রয়েছেন। ইনস্ট্যান্ট তিন তালাক নিয়ে রায়ের সময় আনন্দবাজার পত্রিকায় মোর্তজার একটি বক্তব্য ছাপা হয়। সেখানে তিনি বলেন, ইশরাত যদি নিজেকে শুধরে নেয়, তাহলে এখনও তিনি তার সাথে সংসার করতে রাজী রয়েছেন। তিন তালাক পতিত হওয়ার পরে কি নতুন করে সংসার করার প্রভিশন থাকে? সেইসময় ছিল?
ইশরাত জাহান সুপ্রিমকোর্টে দাখিল করা পিটিশনে উল্লেখ করে ২০১৫ সালের এপ্রিল মাসে তাঁকে ইনস্ট্যান্ট তিন তালাক দেওয়া হয়েছে। হাওড়া ক্রিমিনাল কোর্টে ইশরাত স্বামী, ভাসুর এবং জা-এর বিরুদ্ধে পণ ও নারী নির্যাতনের মামলা করেছিলেন ১৪ই অক্টোবর, ২০১৫ সালে অর্থাৎ ইশরাতের পিটিশন অনুযায়ী তালাক দেওয়ার প্রায় ছয় মাস পরে। অদ্ভুতভাবে, ইশরাত সেই মামলার এফিডেবিটেও ইনস্ট্যান্ট তিন তালাকের কথা উল্লেখ করেননি। বরং তিনি মোর্তজাকে লিগ্যাল স্বামী হিসেবেই উল্লেখ করেছেন।
অর্থাৎ ফ্যাক্ট থেকে পরিষ্কার, ইশরাত জাহানকে মোর্তজা আনসারী দুবাই থেকে ফোনের মাধ্যমে ইনস্ট্যান্ট তিন তালাক দেননি। ইশরাতের অভিযোগ সম্পূর্ণই বানোয়াট। এক্ষেত্রে মোর্তজাই সত্যি কথা বলছেন।
সুপ্রিমকোর্টের রায় এবং ইশরাত জাহানঃ
অনেকেই ভাবতে পারেন, মোর্তজা যদি তিন তালাক না দিয়েই থাকেন, তাহলে সুপ্রিমকোর্ট কিসের ভিত্তিতে ইশরাতের পক্ষে রায় দিল?
মনের ভিতর এমন প্রশ্ন আসা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু মনে রাখতে হবে, সুপ্রিমকোর্টের রায় ছিল সার্বিক ইনস্ট্যান্ট তিন তালাকের উপর। সার্বিকভাবে সুপ্রিমকোর্ট ইনস্ট্যান্ট তিন তালাক অসাংবিধানিক ঘোষণা করেছে। সুপ্রিমকোর্টে এই নিয়ে আর্গুমেন্ট হয়নি যে, ইশরাত জাহানকে তাঁর স্বামী তালাক দিয়েছিলেন কি দেননি? কিংবা পিটিশনের মধ্যে সত্যতা আছে কি নেই? তাই সুপ্রিমকোর্টের রায়ের ভিত্তিতে কখনই এই সিদ্ধান্তে আসা যেতে পারেনা যে, মোর্তজা আনসারী তাঁর স্ত্রীকে ইনস্ট্যান্ট তিন তালাক দিয়েছিলেন।
ইশরাতের সন্তানদের কিডন্যাপ রহস্যঃ
বিহারে শ্বশুরবাড়িতে ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে সন্তানদের ছেড়ে চলে যাওয়ার পরে, ২০১৭ সালের প্রথম দিকে ইশরাত জাহান শ্বশুরবাড়ি গ্রাম থেকে বড়ো মেয়ে এবং ছোট ছেলেকে নিয়ে হাওড়ায় চলে আসেন। কয়েকদিন বাইরে থাকার পরে, হাওড়া ফ্ল্যাটে ওঠেন। মাঝের দুজন সন্তান থেকে যায় গ্রামের বাড়িতেই। এরপর থেকে ইশরাত নিয়মিত স্বামী মোর্তজা আনসারীর ফ্ল্যাটেই থাকেন।
২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে, বকরা ঈদের সময় মোর্তজা দুবাই থেকে পাটনা এয়ারপোর্ট হয়ে গ্রামের বাড়িতে চলে যান। ঈদের দুদিন পরে তিনি হাওড়ার ফ্ল্যাটে আসেন। মোর্তজার বক্তব্য অনুযায়ী, “বাচ্চারা গ্রামের বাড়িতে যেতে চাইলে ইশরাত গেটে তালা ঝুলিয়ে দেয়। বাচ্চারাই মোর্তজাকে ডুপ্লিকেট চাবির সন্ধান দেয়। মোর্তজা সেই চাবি দিয়ে তালা খুলে প্রথমে বাচ্চাদের জামা-কাপড় কিনে দেওয়ার জন্য বাজারে যায়। ইতিমধ্যেই, ইশরাত জাহান এবং তার আইনজীবী নাজিয়া ইলাহী গোলাবাড়ি থানায় গিয়ে অভিযোগ করেন, বাচ্চাদের কিডন্যাপ করা হয়েছে। খবরটি বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম এবং সোশ্যাল মাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়। কিন্তু, কিডন্যাপ হওয়া বাচ্চাগুলি উদ্ধার করা গিয়েছে কিনা, উদ্ধার করা গেলে তাদের এখন কি পরিস্থিতি, কিডন্যাপার খেতে দিয়েছিল কিনা, কতজন কিডন্যাপার ছিল, মারধোর করেছিল কিনা, হাত খোলা নাকি বেঁধে রেখেছিল, কিডন্যাপ করার সময় চোখেমুখে কাপড় বেঁধে নিয়ে গিয়েছিল কিনা- ইত্যাদি বিষয় নিয়ে মিডিয়াতে আর তেমনভাবে কিছুই আলোচনা হয়নি। কিডন্যাপার হিসেবে দাদা মোস্তফা আনসারী নাম উল্লেখ করা হয়। পুলিশ ফোন করে মোস্তফাকে থানায় ডাকে। স্কুল থেকে তিনি থানায় চলে যান। গিয়ে বলেন, বাচ্চারা বাবার সাথে গিয়েছে। এরপর মোস্তফা ফোন করে মোর্তজাকে থানায় ডেকে পাঠান। দুই বাচ্চাকে নিয়ে মোর্তজা সন্ধ্যে ছটার মধ্যে থানায় উপস্থিত হন। জোর করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল কিনা, পুলিশ সেকথা জানতে চায়। কিন্তু বাচ্চারা বাবার সাথেই থাকার কথা জানিয়ে দেয়।
এরপর লিলুয়ার চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কমিটিতে মামলাটি পাঠানো হয়। বাকি দুই সন্তানকে গ্রাম থেকে আনা হয়। শুনানি শুরু হয়। বাচ্চাদের থেকে জানতে চাওয়া হয়, তারা কোথায় থাকতে চায়? বাচ্চারা প্রত্যেকেই বাবার কাছে থাকার কথা জানিয়ে দেয়। শুনানির শেষে চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কমিটির চেয়ারপার্সন শ্রীমতি অমৃতা ঘোষ তিনজনকে বাবার কাস্টডিতে, এবং কনিষ্ঠ সন্তান মোহাঃ জায়েদ আফজালকে মায়ের কাস্টডিতে তুলে দেন। জায়েদ বাবার কাছে যেতে চাইলেও ছোট হওয়ার কারণে অমৃতাদেবী আপাতত মায়ের কাছে পাঠান।
বাচ্চারা মায়ের কাছে থাকতে চায়নাঃ
ছোটো ছোটো সন্তানরা তো মায়ের কাছেই থাকতে বেশী পছন্দ করে। কিন্তু ইশরাত জাহানের বাচ্চারা ব্যতিক্রম কেন? কেন তারা আপন মাকে ছেড়ে বাবা এবং সৎ মায়ের কাছে থাকতে চাইছে? এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার জন্য আমি বিহার থেকে মোর্তজা আনসারী এবং তাঁর তিন সন্তানকে কোলকাতা ডেকে পাঠাই। বাচ্চাদের সাথে কথা বলার জন্য পাঁচজনের একটি টিম গঠন করি। এই টিমে ছিলেন- একজন অমুসলিম বিজ্ঞানী, একজন স্কলার এবং নারী অধিকার আন্দোলনের কর্মী, একজন এমডি ডাক্তার, একজন আইনবিদ এবং আমি। মোস্তফা, মোর্তজা এবং চাচার ছেলে সাথে বাচ্চারা আমার কাছে উপস্থিত হন। বড়দের বের করে দিয়ে আলাদাভাবে বাচ্চাদের সাথে কথা বলি। আমরা জানতে পারি, ইশরাত জাহান তাঁর বাচ্চাদের উপর খুবই অত্যাচার করতেন। প্রেমিক আফজালের কথা যাতে বাচ্চারা কাউকে না জানিয়ে দেয়, সেজন্য ভয়ভীতি প্রদর্শন থেকে মারধোর করতেন। বড় মেয়ের গলায় একাধিকবার ছুরি পর্যন্ত ধরেছেন। ছোট মেয়েকে জ্বলন্ত ধুপকাঠির ছ্যাঁক দেওয়া হয়েছে। বিভিন্নভাবে জানতে চাওয়ার পরে আমদের প্রত্যেকের মনে হয়েছে, বাচ্চারা শিখিয়ে দেওয়া নয়, সত্যি কথাই বলছে।
মোর্তজা আনসারী বাচ্চাদের নিয়ে হাওড়ার এক বন্ধুর ফ্ল্যাটে উঠেছেন। নিজের ফ্ল্যাটে উঠতে পারেননি।
ফ্ল্যাট দখলঃ সুপ্রিমকোর্টের রায়ের পরে আমার যে বন্ধু এবং রাজনৈতিক নেতা আমায় ফোন করে বলেছিলেন, ইশরাত জাহানকে হুমকি দেওয়া হচ্ছে, তাঁর থেকেই জানতে চেয়েছিলাম- ইশরাত জাহান এখন থাকছেন কোথায়? তিনি বলতে পারেননি। আমি সেই আপার থেকে জানতে চেয়েছিলাম। তিনিও হাওড়ার এক জায়গায় আছে বলে ছেড়ে দিয়েছিলেন। পরে জানতে পারি, ইশরাত জাহান আজ অবধি স্বামীর ফ্ল্যাটেই রয়েছেন, যে ফ্ল্যাটে স্বামী তাঁর বাচ্চাদের নিয়ে যেতে পারেন না। আমার মনে প্রশ্ন দানা বাঁধে, ইশরাতকে বড়বড় নেতারা নাকি হুমকি দিয়েছেন, তিনি ভয়ানক অত্যাচারিত-এরপরেও তিনি স্বামীর ফ্ল্যাট দখল করে রয়েছেন? স্বামী ফ্ল্যাটে উঠতে পারেন না? গ্রামের বাড়ি থেকে এসে বন্ধুর বাড়িতে থাকতে হয়? কিভাবে সম্ভব? সবই গোলমেলে...
পরিশেষে বলতে চাই, আমি মনে করি, শুধু মুসলিম কেন? পুরুষতান্ত্রিক সমাজে অধিকাংশ নারীই বঞ্চিত, অত্যাচারিত। আমাদের সকলেরই উচিত নারী অধিকারের পক্ষে কথা বলা, তাদের ন্যায্য দাবী সমর্থন করা। ব্যক্তিগতভাবে আমি সেই মানসিকতা থেকেই প্রাথমিকভাবে ইশরাত জাহানের পাশে আর্থিক এবং সামাজিকভাবে দাঁড়াতে চেয়েছিলাম। সেই সুযোগ পাইনি। দেওয়া হয়নি। এর অর্থ এই যে, মিথ্যা ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে থাকা আন্দোলনকে সমর্থন করতাম! আগে বুঝে নিতাম।
আমি এও মনে করি, ইশরাত নিজেও ভিক্টিম। তিনি রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের ভিক্টিম। বারবার বলেছি, আবার বলছি, ইনস্ট্যান্ট তিন তালাক জঘন্য। কিন্তু মিথ্যার উপর ভিত্তি করে ইনস্ট্যান্ট তিন তালাকের নামে মুসলিম মহিলাদের মুক্তি এবং অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার মিথ্যা দাবী সম্প্রচার আরও বেশি কদর্য। মহিলাদের অধিকার আদায়ের পক্ষেই রয়েছি। তবে মিথ্যার উপর ভিত্তি করে নয়। রয়েছি সত্যের সাথে, সাহসের সাথে।
ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং-এ যারা ছিলেন, যারা অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন, তাদের সকলকে আমার আন্তরিক ভালোবাসা ও সালাম। নিরাপত্তার কারণে তাদের নাম উল্লেখ করতে পারলাম না। আর আমার নিরাপত্তা! ইশরাত জাহানের ছবি নিজের প্রোফাইলে নেওয়ার দুদিন আগে বন্ধু এবং রাজনৈতিক সেই নেতাকে বলেছিলাম, আমায় যদি দুটি অপশন দেওয়া হয়, মৃত্যু এবং বিজেপি- তাহলে আমি মৃত্যুকে বেছে নেবো, ষড়যন্ত্রকারী বিজেপিকে নয়। আমি আমার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি। আপনি আপনার সিদ্ধান্ত ঠিক করে নিন।
(লেখকের অর্ন্ততদন্ত মূলক লেখা)
(লেখকের অর্ন্ততদন্ত মূলক লেখা)
COMMENTS