পুস্তক সমালোচনাঃ বঙ্গবীর তিতুমীর না জ মূ ল হ ক অত্যাচারী জমিদার ও ব্রিটিশ সেনাদের বিরুদ্ধে তিতুমীরের সংগ্রাম নি...
পুস্তক সমালোচনাঃ
বঙ্গবীর তিতুমীর
না জ মূ ল হ ক
অত্যাচারী জমিদার ও ব্রিটিশ সেনাদের বিরুদ্ধে তিতুমীরের সংগ্রাম নিয়ে বহু নাটক, গল্প, কাহিনী, ইতিহাস প্রভৃতি লেখা হয়েছে। আলোচনা হয়েছে বিস্তর। তৈরী হয়েছে মিথ। কেউবা কখনও তাঁকে একজন সাম্প্রদায়িক নেতা হিসাবেও তুলে ধরেছেন। কিন্তু 'বঙ্গবীর তিতুমীর' স্মারক গ্রন্থ পাঠ করে তিতুমীর কে জানতে পারি একজন গরীব কৃষক দরদী মহান বিপ্লবী নেতা ও ইসলাম ধর্মের সংস্কারক রূপে। বইটিতে শিক্ষাবিদ আব্দুল ওহাব সাহেবের লেখনীতে উঠে এসেছে বঙ্গবীর তিতুমীরের তিতুমীরের সঠিক বংশ পরিচয়। সুপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায়, ড.কেয়াম উদ্দিন, উইলিয়াম হান্টার, ড.বিনয় চৌধুরী, তিতুমীরের ভ্রাতুষ্পুত্র আহবাব আলি, অধ্যাপক আব্দুল বারী, সুপ্রকাশ রায় প্রমুখ প্রথিতযশা ঐতিহাসিক গবেষক ও লেখকদের তথ্য সূত্র সহযোগে আব্দুল ওহাব সাহেব তাঁর লেখনীতে সুনিপুণ ভাবে তিতুমীরের বাল্যকাল, শিক্ষা-দীক্ষা, লাউঘাঁটির যুদ্ধ, মোল্লাহাটির যুদ্ধ ও নারকেলবেড়িয়ার যুদ্ধ (বাঁশের কেল্লা) উঠে এসেছে। আবার তাঁর পরাজয়ের কারণ পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে বর্নণা করেছেন লেখক।তিতুমীরের ধর্ম প্রচারকে যারা উগ্রমৌলবাদ বা সাম্প্রদায়িকতার সঙ্গে তুলনা করেন তারা বইটির 'বঙ্গবীর তিতুমীর' বইটি পড়লে তার সুস্পষ্ট জবাব পাবেন। এখান থেকে জানা যায় তিতুমীর মূলত মুসলিম সমাজের 'শিরিক' গুলোকে ধ্বংস করতে চেয়েছিলেন। ওয়াহাবী আন্দোলনের মাধ্যমে হাদিস ও কোরানের প্রচার করে সমাজের সংস্কার সাধনই ছিল তাঁর ধর্মীয় চেতনার মূল লক্ষ্য। যেমন নিরাকার আল্লাহর সঙ্গে কোন কিছুরই শরীক না করা, পীর পূজা বা কবর পূজা না করা, প্রত্যেক মুসলমানের দাঁড়ি রাখা ইত্যাদি। এছাড়াও ড. আব্দুল কাইয়ুম ও তিতুমীরের ষষ্ঠ বংশধর সৈয়দ মদত আলি কতৃক তিতুমীরের বংশতালিকা লিপিবদ্ধ হয়েছে বইটিতে। বিশিষ্ট গবেষক ও লেখক লোকমান হাবিব এর 'মীর নিসার আলি ওরফে তিতুমীর 'নিবন্ধটি পড়ে জানতে পারি তিতুমীরের জীবন পঞ্জী ও বাঁশের কেল্লা থেকে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে অসম লড়াইয়ের বর্ণনা। বিহারী লাল সরকার, আব্দুল গফুর সিদ্দিকী ও ড.মইনুদ্দিন আহমদ খান প্রমুখ ঐতিহাসিক ও সাহিত্যিকের সহায়ক গ্রন্থের সুত্র সহযোগে লোকমান হাবিব তিতুর সেনার সংগ্রাম ও পরাজয়ের কাহিনী এবং ব্রিটিশদের সাথে লড়াইয়ে বন্দী ও নিহত শহীদদের নামের তালিকা ক্রমান্বয়ে লিপিবদ্ধ করেছেন। পরিশেষে মুগ্ধ হতে হয় সাংবাদিক এনামুল হক সংকলিত 'বাঁশের কেল্লা' অংশটি পাঠ করে। ইট, পাথর নয় অদক্ষ কৃষকের হাতে বাঁশের বানানো দুর্গ বা কেল্লা সত্যিই বিস্ময়কর ছিল। ব্রিটিশদের সুসজ্জিত কামান গোলা বন্দুকের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্যে তিতুমীরের রসদ লাঠি, ঢাল, বর্শা, বল্লম, বেল এই কেল্লার ভিতরেই মজুত ছিল।
পরিশেষে বলতে পারি বইটির তথ্য সম্পৃক্ত লেখনী থেকে জানতে পারলাম তিতুমীর কীভাবে সমাজের নীচুতলার মানুষকে একত্রিত করে বাংলা তথা ভারতকে ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন। এছাড়াও বইটির অনেক খানি পাতা জুড়ে বিভিন্ন চিত্র, যেমন-নবনির্মিত তিতুমীর সদন (বাঁশের কেল্লার আদলে), তিতুর সেনাপতি গোলাম মাসুমের ফাঁসতলা (যেখানে গোলাম মাসুমকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়), ঘোড়াপোতা, জন্মভিটা হায়দারপুর শহীদ বেদী প্রভৃতি বইটিকে আরো বেশী সমৃদ্ধ করেছে।
[ইছামতী নদী সংলগ্ন রামচন্দ্রপুর গ্রাম পঞ্চাতের অন্তর্গত ছোট্ট একটি গ্রাম নারকেলবেড়িয়া। শীতের সর্ষে ফুল,পাখির কলরব, প্রকৃতির সারল্য আর পাঁচটা গ্রামের মত নিত্যদিনের কর্ম ব্যস্ততা নিয়েই গ্রামটি বিরাজমান। তবে নারকেলবেড়িয়ার সুনাম বা সুখ্যাতি যতটুকু সম্পূর্ণটাই বাঁশের কেল্লা ও মীর নিসার আলি ওরফে তিতুমীরেরর কারণেই একথা হলফ্ করে বলা যায়। ঐতিহাসিক এই পীঠস্থানের সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ এবং পঃবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদের স্কুল পাঠ্যে তিতুমীরকে নিয়ে বিকৃত ইতিহাস বাতিলের দাবীতে এলাকার সচেতন নাগরিক বিশিষ্টজনদের নিয়ে ২০১৭ সালে গঠিত হয় 'তিতুমীর মিশন'। পুস্তকটির প্রকাশক রবিউল হক হলেন এই মিশনের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। প্রসঙ্গত বলা বাহুল্য মিশনের আন্দোলনের ফলস্বরুপ মধ্যশিক্ষা পর্ষদ- পাঠ্যাংশে তিতুমীরের বিকৃত অংশটুকু প্রত্যাহারের নির্দেশ দেয় এবং ১৭৮২ খ্রীঃএর ২৭ শে জানুয়ারী তিতুমীরের জন্মদিবস সরকারি শীলমোহর পায়। তিতুমীরের স্মৃতিধন্য পূণ্যভূমি নারকেলবেড়িয়াতে ২৭ শে জানুয়ারী,২০১৮ তে সর্বপ্রথম পালিত হয় কৃষক নেতার জন্মদিবস। এই অনুষ্ঠানেই প্রকাশিত হয় 'বঙ্গবীর তিতুমীর' স্মারক গ্রন্থটি। বিস্মৃত অবহেলিত নেতার শ্রদ্ধাঞ্জলি জ্ঞাপনে বইটির আত্মপ্রকাশ ছিল অত্যন্ত গুরুত্ববাহী।
বইটির বিনিময় মূল্য ১০০টাকা।]
---------------------------------