বিশেষ প্রতিবেদন: চীন গার্ডিয়ান : চীনের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জিনজিয়াং প্রদেশটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ। কিন্তু চীনে তারা সংখ্যালঘু।...
বিশেষ প্রতিবেদন: চীন
গার্ডিয়ান :
চীনের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জিনজিয়াং প্রদেশটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ। কিন্তু চীনে তারা সংখ্যালঘু। ক্ষুদ্র এ নৃগোষ্ঠীর লোকেরা উইঘুর মুসলিম হিসেবে পরিচিত। এদের ওপর চীনা সরকারের ব্যাপক দমন-পীড়নের অভিযোগ নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনা রয়েছে। মুসলমানদের বিরুদ্ধে তারা উচ্চ প্রযুক্তির যুদ্ধ ঘোষণা করেছে যেন। রাষ্ট্র তাদের উৎখাতে প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু করেছে। আলিমের গল্পটা তেমন ভবিষ্যতেরই জানান দিচ্ছে।
২০১৭ সালের মাঝামাঝি। দেশের বাইরে লেখাপড়া শেষ করে বাড়ি ফিরেছেন আলিম। বিশের কোঠায় বয়স তার, একজন উইঘুর মুসলমান। কিন্তু দেশে নামতে না নামতেই পুলিশের খপ্পড়ে পড়লেন তিনি। তাকে বলা হলো, বিদেশ ফেরত মানেই তিনি এখন থেকে 'অনিরাপদ' বিবেচিত হয়ে সন্দেহের তালিকায় থাকবেন। পুলিশ প্রশাসন তার ডিএনএ তথ্য, রক্তের গ্রুপ, আঙুলের ছাপ, কণ্ঠের রেকর্ড এবং মুখায়ব স্ক্যানিংসহ বেশ কয়েক বায়োমেট্রিক তথ্য নিয়ে নিলো। এটাকে তারা 'স্বাস্থ্য পরীক্ষা' বলে জানালেন। ধারণা করা হচ্ছে, জিনজিয়াংয়ের উইঘুর অধ্যুষিত এলাকায় সবারই এমন 'স্বাস্থ্য পরীক্ষা' করা হবে।
আলিমের গল্প এখানেই শেষ নয়। তাকে নেয়া হলো উত্তর-পশ্চিম চীনজুড়ে থাকা শত শত বন্দিশিবিরের একটিতে। জি জিনপিং সরকারের কথিত 'সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে জনগণের যুদ্ধের' একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ এই বন্দিশিবিরগুলো। ক্যাম্পেইনটি শুরু হয় ২০১৪ সালে। এর মনোযোগ ছিল জিনজিয়াংয়ের দিকে যেখানে ২৫ মিলিয়ন মানুষের বাস। এদের অর্ধেই উইঘুর মুসলমান। চাইনিজ সরকার সার্বিক বিবেচনায় এ গোষ্ঠীর ইসলামিক মতাদর্শকে চরমপন্থা এবং জাতিগত বিচ্ছিন্নতা বলে ধরে নিলো। ২০১৭ সালের মধ্যেই ১০ লাখের বেশি টার্কিক, উইঘুর, কাজাখ, কিরগিজ এবং অন্যান্য মুসলমানদের এই বন্দিশিবির হয়ে আসতে হয়েছে।
এ শিবিরে আলিমের সময়গুলো মোটেও ভালো কাটেনি। ঘুম এবং খাদ্যের অভাবে কাটাতে হয়েছে তাকে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাকে জিজ্ঞাসাদ করা হয়েছে, গালমন্দ খেতে হয়েছে। আলিমের ভাষ্যে, আমি তাদের এ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে যেতে এতটাই দুর্বল ও বিপর্যস্ত হয়ে পড়ি যে একটা পর্যায়ে গিয়ে আমি হিস্টিরিয়ার রোগীর মতো হাসতে থাকি। কিন্তু প্রতিবাদে কথা বললেই তাদের বৈদ্যুতিক শকের সহ নানা মানসিক নির্যাতন করা হতো। দীর্ঘ সময় থেকে এদের একাকী রাখা হতো। যখন জিজ্ঞাসাবাদ চলতো না, তখন অন্য ২০ জন উইঘুরের সাথে আলিমকে ছোট্ট একটা খুপরি ঘরে রাখা হতো।
এখানে বন্দিদের অধিকাংশকেই আটক করা হয়েছে অনুমাননির্ভর সন্দেহের বশে। নিজের স্মার্টফোনের মাধ্যমে ধর্ম পালন এবং রাজনৈতিক প্রতিহিংসাপরায়ন কর্মকা-ের অভিযোগ তোলা হয়। যদিও অধিকাংশ ক্ষেত্রে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের বিপরীতে অপরাধমূলক কর্মকা-ের স্বপক্ষে কোনো প্রমাণ মেলেনি। অধিকাংশ উইঘুরকে এই শিবিরগুলোতে দীর্ঘ বন্দিত্ব জীবন কাটাতে হবে। বন্দিশিবিরের ক্রমবর্ধমান হারকে সরকার 'শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে পরিবর্তন' এর ব্যবস্থা হিসেবে তুলে ধরছে। মধ্যম নিরাপত্তাব্যবস্থা সম্বলিত এই জেলগুলোতে অনেক সময়ই উইঘুরদের মুসলমানের পরিচয় অস্বীকার করতে এবং চীনা রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদ গ্রহণ করে নিতে প্রচেষ্টা চালানো হয়।
তবে আলিম ছিলেন ভাগ্যবান। মাত্র দুই সপ্তাহের মাথায় তাকে মুক্তি দেয়া হয়। তবে পরে তিনি জানতে পারেন, তারই এক আত্মীয় দ্রুত মুক্তির বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেছিলেন। কিছু দিন পর আবারো একটা ধাক্কা খেলেন তিনি। কয়েক সপ্তাহ বাদেই নিজ শহরেই এক বন্ধুর সঙ্গে শপিং মলে দেখা করতে যাচ্ছিলেন তিনি। মলের প্রবেশদ্বারে থাকা নিরাপত্তাবাহিনী তাকে আটকে দেয়। তার আইডি কার্ড স্ক্যান করা হয়, মুখায়ব স্ক্যানের মেশিনের সামনে দাঁড় করানো হয়। যন্ত্রে একটা অ্যালার্ম বেজে উঠলো। নিরাপত্তাকর্মী তাকে যেতে দিলেন। কিন্তু কয়েক মিনিটের মধ্যেই তার সামনে হাজির হলো পুলিশ কর্মকর্তা। তাকে আবারো জিজ্ঞাসাবাদে নেয়া হলো।
আলিম বুঝতে পারলেন যে তাকে কালো তালিকায় ফেলে দেয়া হয়েছে। এ তালিকা নিয়ন্ত্রণ করে ইন্টিগ্রেটেড জয়েন্ট অপারেশন্স প্লাটফর্ম (আইজপ)। জিনজিয়াংজুড়ে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য চেকপয়েন্টে এসব তালিকা পরীক্ষা করা হয় আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স প্রযুক্তির মাধ্যমে। হাসপাতাল, ব্যাংক, পার্ক কিংবা শপিং সেন্টারে প্রবেশের সময় কালো তালিকাভুক্তরা ক্রমাগত বাধাপ্রাপ্ত হতে থাকবে। তাদের দেখামাত্রা আইজপ পুলিশের কাছে অ্যালার্ম পাঠাবে।
এখন আলিমের আসলে কিছুই করার নেই। পুলিশ তাকে কেবল 'বাসায় অবস্থান' করার নির্দেশনা দেয়। তারা বলে, আবারো বন্দিশিবিরে যেতে না চাইলে বাড়িতে বসে থাকো। যদিও আলিম এখন মুক্ত, কিন্তু তার যাবতীয় তথ্য ডিজিটাল ইতিহাসে জুড়ে দেয়া হয়েছে। সেখানে তিনি রীতিমতো অপরাধী, যার ওপর সর্বদা নজরদারি চলবে। আলিম এখন থেকে তার তথ্য-পরিচয়ের মাধ্যমে নজরদারিতে থাকবেন।
আলিমের এখন 'আমি খুবই ক্ষুব্ধ এবং ভীত' কথাটি বলা ছাড়া আর কিছুই করার নেই।
সৌজন্যে: দৈনিক সংগ্রাম
COMMENTS