গল্প: গনেশের রাজনীতি-শিক্ষালয় রফিউদ্দিন মেজাজটা হঠাৎই খুব ফুরফুরে হলো গনেশের। জীবনে কোনো ইচ্ছেই পূরণ হয়না বলে আক্ষ...
গল্প:
গনেশের রাজনীতি-শিক্ষালয়
রফিউদ্দিন
মেজাজটা হঠাৎই খুব ফুরফুরে হলো গনেশের। জীবনে কোনো ইচ্ছেই পূরণ হয়না বলে আক্ষেপের অন্ত ছিলো না তার। কিন্তু আজ ধূমকেতুর মতো যে ভাবনার জন্ম হলো মনে, গনেশ নিশ্চিত-- এরপর আর কারো সাধ্য হবেনা তাকে গনশা বলে, হস্তিমুণ্ড বলে! বরং অচিরেই তাকে প্রথমে বলতে হবে গনপতি, তারপর ধনপতি! শরীরে খুব শিহরণ হলো, শিস দিয়ে গানের সুর ভাজলো গনেশ।
এ যাবৎ অনেক কিছুই করতে চেয়েছে গনেশ, অনেক মহৎ কাজ হতে পারতো সেগুলো -- কিন্তু লোকে বোঝেনি, উল্টে উপহাস করেছে! এইবার তাই অন্য কিছু নয়, সে খুলবে একটা ইস্কুল। চারপাশে কতো কিসিমের কতোরকম ইস্কুল হচ্ছে, গনেশের ইস্কুল হবে সেইসব থেকে এক্কেবারে অন্যরকম -- কোথ্থাও যা নেই। সে করবে "রাজনীতি শিক্ষালয়"। হাজার হাজার যুবক, যারা যুগের পর যুগ নেতা হবার আশায় নেতাদের তল্পিবাহক হয়ে, স্তাবক হয়ে বুড়ো হয়ে মরে যাওয়াটাই ভাগ্য বলে মেনে নিয়েছে, তারা এখানে উপযুক্ত শিক্ষা পেয়ে উপযুক্ত হয়ে উঠবে। তারা নেতা হয়ে ছড়িয়ে পড়বে সমাজে, তারপর আরেক দল…আরেক দল…আরেক দল । এইভাবে দেশ যেমন নেতায় পরিপূর্ণ হবে, তার নিজেরও "বহুজন হিতায়" ব্রত সিদ্ধ হবে, "বানিজ্যে বসতে লক্ষ্মী"ও হবে। ফলে অচিরেই গনেশ বিত্তবান হয়ে উঠবে এবং সর্বোপরি সবাই তাকে বলবে, সে প্রকৃতই একজন কিং-মেকার, যথার্থ দেশগৌরব!
অনেক ভেবে গনেশ ঠিক করলো, শিক্ষালয়ের জন্য প্রথমেই দরকার শিক্ষার্থী আর শিক্ষক, ভবনের ভাবনাটা তারপর। দেরি না করে সে এ-পাড়ার ও-পাড়ার মন্টু, বাপি, রাজু, হান্নানদের কাছে তার পরিকল্পনা জানালো। সবাই বাহা বাহা করলো। যে শুনলো সে-ই ছাত্র হতে চায়। গনেশ ছুটলো অতি ছোটো থেকে ছোটো, মধ্য-মাঝারি থেকে মাঝারি -- কাছেপিঠের নেতাদের কাছে। তার ইচ্ছে শুনে তাঁরাও খুব বাহা বাহা করলেন এবং এহেন অভূতপূর্ব শিক্ষালয়ের সঙ্গে যুক্ত থাকার আগ্রহ দেখালেন। সবাই বললেন, একটা কাজের মতো কাজ হবে এইবার, অবশ্যই পড়ুয়া পাঠাবেন। উৎসাহে উদ্দীপনায় টগবগিয়ে চললো গনেশ। মাঝারি ছেড়ে মোটামুটি নেতাদের আশীর্বাদ নিয়ে ফেললো অল্পদিনেই।
সেদিন এক প্রায়-মোটা নেতার সাক্ষাতে গেলো গনেশ। শিক্ষার্থী যে তার উপছে পড়বে -- এই ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে গনেশ তখন শিক্ষক খুঁজতে নেমেছে। এক মাঝারি নেতা-ই বলেছেন এই নেতার কথা। ইনি মঞ্চে উঠলে নাকি অন্য নেতাদের জিভ শুকিয়ে আসে, আর পাবলিক মশাইরা হাঁচি-কাশিও ভুলে যায়। এনার প্রভাব প্রতিপত্তি দেখে প্রায়-মোটা নেতারা তো কোন ছার, আচ্ছা আচ্ছা মোটাসোটা নেতারাও নাকি ঈর্ষা করেন। ইনি নিজেও নাকি এককালে শাকরেদগিরি করেছেন, তখন পেশায় ছিলেন আলু-পেঁয়াজের দোকানদার, উথ্থান হয়েছে তরতর করে, এখন শাঁসালো মানুষ। গুটিগুটি পায়ে গনেশ গেলো তাঁর কাছে।
তিনি ছিলেন পারিষদ পরিবৃত হয়ে। সেখানে সমস্যা জানাবার জনতা কিছু ছিলো, সমস্যা তৈরির লাল্টু-বল্টুও কিছু ছিলো। গদগদ গনেশ জোড়হাতে গিয়ে সামনে দাঁড়ালো। বললো, দাদা, অমুক দাদা পাঠিয়েছেন। দাদা মুখ ফেরালেন তার দিকে
--- কী ব্যাপারে?
--- আজ্ঞে একটু যদি একান্তে কথা বলার সুযোগ দেন দয়া করে…
--- সুযোগ হচ্ছে না ভাই, এখানেই বলো।
গনেশ সবিনয়ে সবিস্তারে বললো। সব শুনে দাদা যেন খুশি হলেন খুব,
--- বোয়া বোয়া… দারুন আইডিয়া! সত্যি এট্টা দেশের কাজ বটে! তা আমাকে কী করতে হবে?
--- আজ্ঞে ক্লাস নিতে হবে।
--- উত্তম উত্তম! ক্লাসের বিষয়?
--- আপাতত ভেবেছি দাদা চারটে-পাঁচটা-ছটা বিষয় দিয়ে শুরু করবো। তারপর আপনারা যদি আর কিছু বিষয় বাড়াতে চান…
--- চারটে-পাঁচটা-ছটা কী কী?
--- একটা হলো, 'সত্যরূপে মিথ্যাভাষণ', থাকবে 'পোষাক ও আচার বিধি', তারপর আছে 'বুদ্ধিবল ও বাহুবল', 'তোষণ ও পোষণ পদ্ধতি', 'আত্মসাতের নন্দনতত্ত্ব' ইত্যাদি।
দাদা একটু হাসলেন। বললেন, আমার বিষয় কোনটা?
গদগদ গনেশ বললো,আজ্ঞে, আত্মসাতের নন্দনতত্ত্ব বা বুদ্ধিবল ও বাহুবল -- যেটা আপনার পছন্দ।
দাদা হঠাৎ গম্ভীর হলেন ও হাঁকলেন,বল্টু?
--- বলো দাদা?
--- বাহুবলের ক্লাসটাই ভালো। এইটা তুই নিবি। নে, শুরু কর!
তারপরের ঘটনা সংক্ষিপ্ত। গনেশ এখন ভাঙা হাত-পায় প্লাস্টার মুড়ে ঘরে পড়ে আছে। নাক মুখ তার ফোলা। দেহে মনে ব্যথা তার অনেক, কিন্তু সে কিছুতেই বুঝতে পারছে না,উত্তম উত্তম বলার পর উত্তম মধ্যম হয় কি করে !!
COMMENTS