নিবন্ধ: শিক্ষক আন্দোলন পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষকদের আন্দোলন ও সরকারের উদাসীনতা রাকিবুল ইসলাম সাম্প্রতিক বিকাশ ভবনের সামনে পাঁচজন শিক্ষিকা বিষ খ...
নিবন্ধ: শিক্ষক আন্দোলন
পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষকদের আন্দোলন ও সরকারের উদাসীনতা
রাকিবুল ইসলাম
সাম্প্রতিক বিকাশ ভবনের সামনে পাঁচজন শিক্ষিকা বিষ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করে। বিভিন্ন গণমাধ্যমের সূত্রে যে সমস্ত ভিডিও গুলো প্রকাশ পেয়েছে সেখানে দেখা যাচ্ছে পুলিশের সামনেই পাঁচজন শিক্ষিকা তাদের সঙ্গে নিয়ে আসা বিষের পাত্র থেকে বিষপান করছেন। এই বিষয় নিয়ে জনসাধারণের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কেউ কেউ বলছেন শিক্ষক হিসেবে তাদের এহেন আচরণ ঠিক হয়নি। ঠিক ভুলের প্রশ্নে না গিয়ে একটা বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছি। পশ্চিমবঙ্গে বেশ কয়েক বছর ধরে চলছে বিভিন্ন ধরনের শিক্ষক আন্দোলন। একটা সময় দেখা গেছে স্থায়ী শিক্ষকরা আন্দোলন করেছেন বেতন বৃদ্ধির জন্য। পার্শ্ব শিক্ষক-শিক্ষিকা, এসএসকে, এমএসকে এবং সমগ্র শিক্ষা অভিযানের সঙ্গে যুক্ত শিক্ষক এবং অশিক্ষক কর্মচারীরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে পথে নেমেছে। মমতা ব্যানার্জির সরকারের পূর্বের শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বিভিন্ন সময় নিযুক্ত হওয়া চুক্তিভিত্তিক এ সমস্ত শিক্ষকদের দাবি-দাওয়ার ব্যাপারে কোন প্রকার আলোচনার উৎসাহ দেখায়নি। মমতা ব্যানার্জির নতুন সরকারের শিক্ষা মন্ত্রী দায়িত্ব পাওয়া ব্রাত্য বসুর কাছে পার্শ্বশিক্ষক, এমএসকে, এসএসকে শিক্ষক এবং সমগ্র শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত সমস্ত শিক্ষক- অশিক্ষক কর্মচারীরা আশায় বুক বেধে ছিল যে কিছু না হোক শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু শিক্ষকদের সঙ্গে একটা আলোচনার পরিবেশ তৈরি করবেন। নতুন সরকার গঠন হওয়ার পর বিভিন্ন সময় নিযুক্ত হয় চুক্তিভিত্তিক এবং অস্থায়ী শিক্ষক সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে বিভিন্নভাবে মন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার চেষ্টা করা হলেও তা ব্যর্থ হয়। উল্টে যে সমস্ত শিক্ষক-শিক্ষিকারা শিক্ষক আন্দোলন যুক্ত ছিলেন তাদের উপরে নেমে আসে সরকারি শাস্তির খাঁড়া। তাদের বদলির চিঠি পাঠানো হয়। হয়তো সরকারের এই প্রতিহিংসামূলক নীতির বিরুদ্ধে তারা তাদের আবেগকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেননি সেজন্য এমনভাবে প্রতিবাদে নেমে পড়লেন যেখানে জীবনটাই সংশয় হয়ে পড়ে গেল!
এই শিক্ষক-শিক্ষিকাদের কাজটা কী হতে পারে বলে মনে হয় চলুন দেখে নিই। এই শিক্ষক-শিক্ষিকাদের কাজ অন্যান্য শিক্ষক শিক্ষিকাদের মতই। প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং উচ্চ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সর্ব শিক্ষা অভিযানের আওতায় নিযুক্ত হয় পার্শ্বশিক্ষকরা। তারা অন্যান্য শিক্ষকদের সঙ্গে সমাজের দায়িত্ব পালন করে পাশাপাশি স্থানীয় হওয়ার সুবাদে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কাজে বিদ্যালয়কে সাহায্য করতে হয়। তাছাড়া বিশেষভাবে পার্শ্বশিক্ষকদের অতিরিক্ত যে কাজটি করতে হয় তা হল বিভিন্ন সময়ে স্কুল ছুট বাচ্চাদের স্কুলে ফিরিয়ে আনার জন্য সপ্তাহে এক বা দুদিন বাড়ি বাড়ি গিয়ে সাক্ষাৎ করে স্কুলের ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করতে হয়।
এমএসকে অর্থাৎ মাধ্যমিক শিক্ষা কেন্দ্র এখানকার শিক্ষকদের কাজ মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষকদের মত। তেমনি এসএসকে অর্থাৎ শিশু শিক্ষা কেন্দ্র। এই শিশু শিক্ষা কেন্দ্রের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের ভূমিকা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের মত।
এই শিক্ষক-শিক্ষিকাদের ভাতা কেমন চলুন দেখি। পার্শ্বশিক্ষক, এসএসকে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের বর্তমানে ১০০০০
টাকা। এরমধ্যে পিএফ হিসেবে চলে যায় প্রায় ১২০০। এমএসকে এবং আপার প্রাইমারি পার্শ্বশিক্ষকদের বেতন মাসে ১৩০০। একই অফিসে বসে যখন একই কাজের জন্য একজন শিক্ষক মাহিনা তোলেন 30000 আর অন্যজন মাত্র ৮৮০০। এটা কোন ধরনের বৈষম্য।
দীর্ঘ দিন পার্শ্ব শিক্ষকরা উপযুক্ত বেতন কাঠামোর দাবি নিয়ে বারংবার আন্দোলন করেছে। সরকার তাদের দাবিদাওয়া গুলো শুনবার জন্য নূন্যতম আগ্রহ দেখায়নি। গণতান্ত্রিক দেশে বিভিন্ন দাবিতে মানুষ আন্দোলন করতে পারে। তেমনি সরকারেরও অধিকার আছে দাবিদাওয়া না মেনে নেওয়া। তবে আলোচনায় না বসা এবং বিরোধীদের চক্রান্ত বলে বিষয়টাকে ব্যাখ্যা করার প্রবণতা দুর্ভাগ্যজনক।
ভারতীয় সংবিধানের আর্টিকেল নং 39(d) এবং ৪১ তে সম কাজের জন্য সম বেতনের কথা বলা থাকলেও সরকার এ ব্যাপারে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহনে পুরোপুরি ব্যর্থ।
প্রসঙ্গত: বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তখন বিরোধী নেত্রী, সেসময়ে পার্শ্ব শিক্ষকদের ধর্নামঞ্চে উপস্থিত হয়ে বলেন তিনি রাজ্যের ক্ষমতায় এলে ধাপে ধাপে পার্শ্ব শিক্ষকদের স্থায়ী করবেন। আজ তিনি বেমালুম ভুলে গেছেন!
অনেকসময় স্থায়ী করণের প্রশ্নে অনেকে তুলে ধরেন এসএসসি আর টেট-এর কথা। তাদের একথা ভাবতে হবে এ রাজ্যে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ভাবে শিক্ষক নিয়োগ হয়েছে সেসব ক্ষেত্রে কখনো সেই সমস্ত শিক্ষকদের যোগ্যতা নিয়ে কোন রকম প্রশ্ন তোলা হয়নি। একটা সময় স্কুল পরিচালন কমিটি শিক্ষক নিয়োগ করে ছিল। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শুধু মাত্র এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ হয়েছে। তাদের স্থায়ী শিক্ষক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু যত সমস্যা এই পার্শ্ব শিক্ষকদের ক্ষেত্রে!
সেই ২০০৪ সালে নিয়োগ হওয়া পার্শ্ব শিক্ষকদের অনেকে দারিদ্রতার সাথে লড়াই করতে করতে অবসরের বয়সে পৌঁছে গেছেন। কেউ কেউ হতাশায় অকালে ঝরে পড়ে গেছেন। কেউ দারিদ্রতা চাপ সহ্য করতে না পেরে বেছে নিয়েছেন স্বেচ্ছা মৃত্যুর মত ভয়ঙ্কর পথ। আর যারা টিকে আছেন তারা অতিরিক্ত সময় বিভিন্ন কাজের সঙ্গে যুক্ত থেকে সংসারের স্বচ্ছলতা ফেরানোর সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন।
শিক্ষার মত এক মহান পেশায় সঙ্গে যুক্ত থেকে একজন মানুষকে যখন সমাজ আর সহকর্মীদের থেকে বারবার জুটতে থাকে অবজ্ঞা, তখন সত্যিই একজন শিক্ষক নিজেকে কতটা শিক্ষক হিসেবে ভাবতে পারেন এটা অনুভব করা কঠিন।
শিক্ষকদের এই আন্দোলন যদি সরকারকে আলোচনার পথ তৈরী না করে দেয়, তবে বলতে হবে সরকার এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে একেবারে উদাসীন। এই উদাসীনতা আগামীতে সরকারকে চরম মূল্য চুকাতে না হয়!
COMMENTS