পুস্তক সমালোচনা: তালাশনামা বাঙালি মুসলিম সমাজের মহাকাব্যিক প্রেক্ষাপটে রচিত একটি উপন্যাস 'তালাশনামা' 🖋️ তৈমুর খান ইসমাইল দরবেশে...
পুস্তক সমালোচনা: তালাশনামা
বাঙালি মুসলিম সমাজের মহাকাব্যিক প্রেক্ষাপটে রচিত একটি উপন্যাস 'তালাশনামা'
🖋️ তৈমুর খান
ইসমাইল দরবেশের ‘তালাশনামা’ (প্রথম প্রকাশ ২০২১) এক আলোক অভিমুখের সন্ধানে উদ্দীপিত বৃহৎ এক আঞ্চলিক উপন্যাস। তবে আঞ্চলিক হলেও বৃহত্তর বাঙালি মুসলিম সমাজের মহাকাব্যিক প্রেক্ষাপটে এর উত্তরণ ঘটেছে। হাওড়া জেলার সদনাহাটি নামে গ্রামের মানুষ কাপড়ের কাজ-কারবারি ওস্তাগর। কেউ শ্রমিক, কেউ মালিক। বেশিরভাগই ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। কাপড়ে নকশা তোলা, জরির কাজ করা, সেলাই করা এবং সেসব পণ্য বাজারজাত করাই তাদের কাজ। সবাই ব্যস্ত মানুষ। সপ্তাহে দুদিন হাট। এই ব্যস্ততার মধ্যেই তাদের জীবন-জীবিকা, দাম্পত্য-প্রেম, ধর্ম পালন, আধ্যাত্মিক ভাবনা, আশা-আকাঙ্ক্ষা, রাজনৈতিক জীবন, সততা ও নৈতিকতা গড়ে উঠেছে। গ্রামের অধিকাংশ মানুষই মুসলিম সম্প্রদায় হলেও তাদের মধ্যে বহু পন্থী বা ‘সিলসিলা’র দেখা পাওয়া যায়। যেমন ফুরফুরা, তবলিগ জামাত, লা-মাজহাব, হানাফি ইত্যাদি। হিন্দুপাড়ায় বেশকয়েক ঘর নাথ বা যোগী ব্রাহ্মণ সম্প্রদায় মানুষের বসবাস।
মূল ঘটনার উদ্ভব ঘটেছে গ্রামের মসজিদ ও তাহিরুল মাওলানাকে কেন্দ্র করে। মসজিদের সম্পত্তি গ্রামের মিঞারা ভোগ করে। এই সম্পত্তি উদ্ধার করার উদ্যোগ দেখা দিলে মিঞারা গোপনে নিজেদের নামে রেকর্ড করে নেয়। মুসল্লি, মোতায়াল্লি, ইমামকে নিয়েই মসজিদ কমিটি গড়ে ওঠে। বাস্তবতা হলো ইমামকে কিছু লোক প্রশ্রয় দিলেও, কিছু লোক সর্বদা বিরোধিতা করে। তার দোষ-ত্রুটি খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তাহিরুল মাওলানা অল্পদিনেই গ্রামের মানুষের ওপর একটি প্রভাব বিস্তার করে ফেলে। প্রতিদিনই সে আরবি শিক্ষা দিতে কালু মিঞার বাড়িতে যায়। এখানেই পড়তে আসে কালু ও সালাম মিঞার দূরসম্পর্কের পিতৃমাতৃহীন কলেজে পাঠরতা ভাগ্নি রিজিয়া। তার মেধা, ব্যক্তিত্ব, চালচলনের সপ্রতিভ প্রকাশ দেখে মাওলানা প্রেমে পড়ে যান। এক সময় তাকে বই ও দামি চুড়িদার উপহার দেন। রিজিয়াও আতর, পাঞ্জাবির বোতাম এবং টুপি পাঠায়। উভই উভয়কেই সম্মতি জানায়। রিজিয়া তার মায়ের পৈত্রিক সম্পত্তির অংশ এক বিঘা জমির মালিক হয়। এই সম্পত্তি আত্মসাৎ করার উদ্দেশ্যেই কালু মিঞা তার ছোট ছেলে নেশাখোর লম্পট রাকিবের সঙ্গে তার বিয়ে ঠিক করে। অশিক্ষিত চরিত্রহীন রাকিবকে রিজিয়া বরাবরই ঘৃণা করে। তাই এই বিয়েতেও অসম্মতি জানায়। একথা সরাসরি রাকিবকে বলতে গিয়ে তার দেওয়া চায়ের সঙ্গে নেশার ওষুধ খেয়ে বেহুঁশ হয়ে পড়ে। এই সুযোগে রাকিব তাকে ধর্ষণ করে। আর ধর্ষণের ফলেই তার পেটে আসে সন্তান। এখানেই সৃষ্টি হয় জটিলতা। কুমারী হৃদয়ের হাহাকার ও কষ্টের মধ্যেই বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে রিজিয়া। তার ভালোবাসার জন্য তাহিরুল মাওলানার কাছে মধ্যরাতে গোপনে ছুটে যায়। তাকে নিয়ে ঘর বাঁধতে চায় অন্য কোথাও। কিন্তু মাওলানা একজন ইমাম বলে সম্মান রক্ষা করার জন্য লোকলজ্জার ভয়ে এ কাজ করতে পারে না। তবে কথা দেয় কুরবানীর পরেই তাকে বিয়ে করার ঘোষণা দেবে।
এদিকে সমস্ত গ্রামজুড়ে সৃষ্টি হয় নানা অমূলক অপপ্রচার। মাওলানার নামে রটে যায় কলঙ্ক। তাহিরুল ইমামতিতে ইস্তফা দিয়ে গ্রাম ছাড়তে বাধ্য হন। কিন্তু রিজিয়ার জন্য তার যে দ্বান্দ্বিক পরিস্থিতির এবং আত্মদহনের সৃষ্টি হয় তাতে সে মুহ্যমান হয়ে পড়ে। রিজিয়াও আত্মপীড়নের শিকার হয়ে ভাগ্যবিড়ম্বিতা নারীতে পরিণত হয়। উপায়ান্তর না দেখে পুনেতে পালিয়ে যাওয়া রাকিবের কাছেই যেতে চায়, কারণ তারই সন্তান তার পেটে। তার টিউশান মাস্টার সুমন নাথের কাছে যুক্তি ও পরামর্শ চায়। সুমন তাকে সব রকম সাহায্যের আশ্বাস দেয়।
এদিকে সুমনের পিসতুতো ভাই সন্দীপ মুসলিম বিরোধী একটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত। সে এসে সব শুনে এই সুযোগকে কাজে লাগাতে চায়। সুমনকে উৎসাহিত করে রিজিয়াকে নিয়ে পালানোর। সুমনের সুপ্ত ভালোবাসা জেগে ওঠে। রাতের বেলা বাইকে চাপিয়ে গ্রাম ত্যাগ করতে সন্দীপই সাহায্য করে। সন্দীপের আসল উদ্দেশ্য হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গা বাধানো। তাই রিজিয়া গ্রাম ত্যাগ করলে রিজিয়ার নাম দিয়ে মসজিদের দেওয়ালে সে লিখে দেয়:
“হরে কৃষ্ণ হরে রাম। আমি ইসলাম ত্যাগ করে হিন্দু হলাম। যত নষ্টের গোড়া তোদের ওই ইমাম। ইমামদের কথামতো কেউ চলবে না, এটা বলে গেলাম। ইতি— রিজিয়া খাতুন।”
কিন্তু শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের প্রচেষ্টায় দাঙ্গা থামানো সম্ভব হয়।
সদনাহাটি গ্রামের মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষের ধর্মীয় চেতনায় বেদাত, শিরিক, সুফিতত্ত্ব, হজ, যাকাত, ঈদ-কোরবানি, খাতনা, বিবাহ, তালাক, গোসল,কুলুখ, দাফন কার্য প্রসঙ্গক্রমে সবকিছুরই অতি সূক্ষ্ম পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোকপাত করা হয়েছে। শুধু ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ নয়, এর বৈজ্ঞানিক ভিত্তিরও যুক্তিগ্রাহ্য আলোকপাত আছে। সুমনের ভাবনার মধ্যে দিয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের নানা ভ্রান্ত ধারণারও উত্থাপন করা হয়েছে। যেমন মুসলিমরা পবিত্র হয়ে জানাজা নামাজ আদায় করে, অন্যদিকে হিন্দুরা মদ খেয়ে নেশার ঘোরে দাহ কার্য সম্পন্ন করে। মুসলমানরা নাকি গোঁয়ার, মূর্খ, হিংস্র বলেই হিন্দুরা মনে করে। এই ধারণাও ভুল সুমন তা বুঝতে পারে। মুসলিমরা বহুবিবাহ করে, গণ্ডায় গণ্ডায় সন্তান জন্মায় একথাও বিশ্বাসযোগ্য নয়।
উপন্যাসের শেষ অংশে নতুন মসজিদ কমিটির উদ্যোক্তাগণ মারুফ, ডা. জসিম উদ্দিন,ফরিদ প্রমুখ সদনাহাটি সমাজসেবী সংঘ যে অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে তাতে গ্রামের মানুষের চেতনায় নতুন করে জাগরণ এসেছে। রক্তদান, দাতব্য চিকিৎসালয়, লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা, কম্পিউটার শিক্ষা প্রভৃতি সবই বর্তমান সভ্যতার উপযুক্ত বিষয়। সত্যান্বেষী, যুক্তিনিষ্ঠ, স্বশিক্ষিত, বুদ্ধিদীপ্ত মারুফের নেতৃত্ব সকলের কাছেই গ্রহণীয় হয়ে উঠেছে। এই অনুষ্ঠান মঞ্চেই মিলিত হয়েছে ধর্মতাত্ত্বিক তাহিরুল এবং মুক্তমনা রিজিয়া। রাজনৈতিক নেতা রফিকুল এর ভণ্ডামি এবং স্বার্থপরতা সকলের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
উপন্যাসের বহুমুখী বিস্তার, কাহিনি ও উপকাহিনির জটিলতায় সদনাহাটির মানুষের দীর্ঘশ্বাস ও স্বপ্ন দর্শনের মুহূর্তগুলি যেমন উঠে এসেছে, তেমনি সেখানকার জনগণের সারল্য কপটতা তঞ্চকতা এবং স্বার্থপরতাও বাস্তবোচিত মনস্তাত্ত্বিক উপায়ে লেখক তুলে ধরেছেন। কাহিনির স্বচ্ছ গতিশীলতা, স্থানীয় ভাষার প্রয়োগ, উচ্চারণের অকৃত্রিমতা এবং বর্ণনার গুণে এটিকে মহাকাব্যিক আখ্যানের পর্যায়ে উন্নীত করেছে। সুমনের আত্মহত্যা যে দ্বান্দ্বিক ক্ষতবিক্ষত হৃদয়েরই ফল তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
কতগুলি বাক্য প্রবাদ বাক্যের মতোই গুরুত্বপূর্ণ :
১। ‘মানুষ ক্রমশই রীতি ও রেওয়াজের গোলমতি করচে।’ (অর্থ না বুঝে কোরআন পাঠ সম্পর্কে)
২। ‘পালা করা খাবারের থালায় অনেক শ্রদ্ধা আছে, ভক্তি আছে; কিন্তু ভালোবাসা নেই। মমতাও নেই।’ (মাওলানার পালি খাওয়া সম্পর্কে)
৩। ‘শরতের সকালে ফুটে থাকা সতেজ একটি শিউলি ফুল।' (রিজিয়া সম্পর্কে)
৪। ‘বাহ্ রিজি! তোকে তো পুরো হুজুরের বিবিই লাগছে!’ (আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে রিজিয়ার নিজেকেই উপলব্ধি)
৫। ‘দরজা খোলা থাকলেই তো ঢোকা যায় না সব জায়গায়।’ (মুসলমান সমাজকে বুঝতে না পারা সুমন সম্পর্কে)
৬। ‘একটি তীব্র আদিম অসুখে আক্রান্ত হয়ে উঠেছে সে।’ (ভেজা গেঞ্জি লেপ্টে থাকা তাহিরুলের খোলা পিঠ দেখে রিজিয়ার উপলব্ধি)
৭। ‘অন্য সকলের চেয়ে আলাদা একটি লাবণ্য আছে, ভিন্নধর্মী শারীরিক ভাষা আছে। চিন্তা-চেতনায় অনেকটাই প্রগতিশীলতার আভাস আছে।’ (রিজিয়া সম্পর্কে তাহিরুলের উপলব্ধি)
৮। ‘আমি তো তোমার সঙ্গে ঘর বাঁধব বলে বেরিয়ে আসিনি সুমন। আমার অসহায়তার সুযোগ নিয়ে তুমিই বরং বাধ্য করিয়েছিলে।’ (পাল্টে যাওয়া সুমন সম্পর্কে রিজিয়ার বক্তব্য)
পাঠক বেশকিছু নতুন শব্দেরও সম্মুখীন হবে সবগুলিই আগন্তুক শব্দ। যেমন: চিকিল্লা, সওয়াব, রেসানি, চল্লিশা, কুলখানি, ওয়াজ নসিহত, সিলসিলা, মাজহাব, হানাফি, ইজমা কেয়াস, ফেরকা, বেদাত, আক্বিদা, তৌহিদ, মাবুদ, তাওয়াফ, তাহজিব, ফায়েজ, শান-শওকত, তাসউফ, মোনাফেক, আরমান, খালেস দিল, মোহরে ফাতেমি, তসরিপ, ফায়েজ, তাজিম, হিফজ, দস্তারবন্দি, লা-মাজহাবি, ডবডবানি, বুহতান ইত্যাদি।
সমগ্র মুসলমান সমাজকে তথা মুসলমান সংস্কৃতিকে, এমনকী তাদের রুচি-মনন- আধ্যাত্মিকতাকে কাহিনির সূক্ষ্ম বুননে জমাটবদ্ধ করেছেন। ভিন্নধর্মীয়দের কাছে মুসলিম সম্প্রদায় সম্পর্কে কীরকম ভ্রান্ত ধারণা এবং ভিন্নধর্মীয়দের সম্পর্কে মুসলমানদের ধারণা কীরকম তা স্পষ্ট করেছেন। কতগুলি বিষয়ে প্রশ্ন তুলে দিয়েছেন যার উত্তর আমাদেরও জানা নেই। যেমন খ্রিস্টান ও মুসলমানরা প্রায় সমগোত্রীয় হলেও হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে শুধুমাত্র মুসলমানরাই কেন ব্রাত্য, খ্রিস্টানরা নয় কেন? মুসলমানদের গোরু খাওয়াতেই আপত্তি কেন, অন্য প্রাণীতে নয় কেন? ইত্যাদি। শুধু বাংলা সাহিত্যে কেন, বিশ্বসাহিত্যেও এরকম একটি গ্রন্থ বিরল বলেই মনে হয়।
তালাশনামা: ইসমাইল দরবেশ, অভিযান পাবলিশার্স,১০/২ এ রমানাথ মজুমদার স্ট্রিট, কলকাতা:৭০০০০৯, মূল্য: ৫০০ টাকা।
COMMENTS