উপসম্পাদকীয়: Waqf Board Amendment Bill কেন্দ্রের ওয়াকফ সংশোধনী বিল-২০২৪ মুসলিমদের অধিকারে বেনজির হস্তক্ষেপ আবারও দেশজুড়ে এক নতুন বিতর্কে...
উপসম্পাদকীয়:
Waqf Board Amendment Bill
কেন্দ্রের ওয়াকফ সংশোধনী বিল-২০২৪ মুসলিমদের অধিকারে বেনজির হস্তক্ষেপ
আবারও দেশজুড়ে এক নতুন বিতর্কের জন্ম দিতে চলেছে ওয়াকফ সংশোধন বিল-২০২৪। এই বিলের লক্ষ্য বেশ পরিস্কার। সরকার এবার সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে চাইছে। একদিকে মেরুকরণ অন্যদিকে মুসলিমদের সাংবিধানিক অধিকার খর্ব, এক ঢিলে দুই পাখি মারতে চাইছে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার।
মোঃ রাকিবুল ইসলাম
কেন্দ্রের শাসক এনডিএ সরকারের প্রধান শরিক বিজেপির এবার নজর পড়েছে ওয়াকফ সম্পত্তির উপর। কিভাবে ওয়াকফ সম্পত্তির উপর থাবা বসানো যায় তারই উদ্যোগ গ্রহণ করেছে সরকার। ১৯৫৪ সালে সংবিধানের ৯(১) এর বিধান অনুযায়ী ওয়াকফ বোর্ড প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং ১৯৯৫ ওয়াকফ আইন পাশ করা হয়। সেখানে বলা হয় কোন জমির দলিল যাচাই করে ওয়াকফ বোর্ড সেই জমি যদি ওয়াকফ সম্পত্তি হয় তবে তা ওয়াকফ বোর্ডের অন্তর্ভুক্ত করতে পারবে। কিন্তু বর্তমান শাসক চাইছে এই অধিকার কেড়ে নিতে। বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকে দেশের নাগরিকদের অধিকারের প্রশ্নে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করতে চাইছে। এমন কি তাদের প্রধান অস্ত্র মেরুকরণ। সেই মেরুকরণের সস্তা রাজনীতি করে জনগণকে ভাগ করে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় টিকে থাকতে চাইছে। পূর্বে যেমন সরকারের মেরুকরণের হীন চক্রান্ত জনগণ রুখে দিয়েছে, আগামীতেও জনগণ তা রুখে দেবে।
ওয়াকফ সম্পত্তি:
সহজ কথায়, যখন কোন মুসলিম ব্যক্তি তার স্থাবর বা অস্থাবর সম্পত্তি আল্লাহর নামে দাতব্য বা ধর্মীয় উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করে তখন তাকে ওয়াকফ বলা হয় এবং এ জাতীয় সম্পত্তিকে ওয়াকফ সম্পত্তি বলে। ওয়াকফ করার পরে একটি আর ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য ব্যবহার করা যায় না। ওয়াকফের আভিধানিক অর্থ হল আটক বা বন্দী করা এবং নিষেধাজ্ঞা। ইসলাম অনুসারে, এটি এমন সম্পত্তি যা এখন শুধুমাত্র ধর্মীয় বা দাতব্য উদ্দেশ্যে উপলব্ধ এবং সম্পত্তির অন্য কোন ব্যবহার বা বিক্রয় নিষিদ্ধ। শরিয়া আইন অনুসারে, একবার ওয়াকফ প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে এবং সম্পত্তিটি ওয়াকফের জন্য উৎসর্গ করা হলে তা চিরকালের জন্য ওয়াকফ সম্পত্তি হিসাবে থাকে।
ওয়াকফ বোর্ড:
ওয়াকফ আইন, ১৯৫৪-এর ধারা ৯(১) এর বিধান অনুযায়ী রাজ্য সরকারগুলো রাজ্য ওয়াকফ বোর্ডগুলি প্রতিষ্ঠা করে। এগুলো জেলা ওয়াকফ কমিটি, ব্লক ওয়াকফ কমিটি প্রভৃতি পৃথক পৃথক ওয়াকফ প্রতিষ্ঠানের জন্য কমিটি গঠন করে ওয়াকফ সম্পত্তির ব্যবস্থাপনা, নিয়ন্ত্রণ এবং সুরক্ষার জন্য কাজ করে। পরবর্তীতে ওয়াকফ বোর্ড আইন-১৯৯৫ এর অধীনে, ওই বোর্ড ওয়াকফ দলিলের মাধ্যমে, সমীক্ষা করে বা ক্রমাগত ব্যবহার করা হয়েছে কিনা এই তথ্য যাচাইয়ের মাধ্যমে কোনও সম্পত্তি ওয়াকফের অন্তর্ভুক্ত করতে পারে। যদিও কেন্দ্রের বিজেপি আগামীতে এর পরিবর্তন আনতে ছাইছে বিভিন্ন অভিযোগের ইঙ্গিত করে। ওয়াকফ বোর্ড ঈদগাহ, কবরস্থান, মসজিদ, খামার, দালানকোঠা, বাগান বা যে কোনো ধরনের সম্পত্তি ওয়াকফের আওতায় নেওয়ার ক্ষমতা রখতো।
ভারতের ওয়াকফ সম্পত্তির পরিমাণ:
রেল এবং সেনাবাহিনীর সম্পত্তির হাতে থাকা জমির পর সবচেয়ে বেশি জমির মালিক ওয়াক বোর্ড। বর্তমানে ভারত জুড়ে 9.4 লক্ষ একর জম আছে ওয়াকফ বোর্ডের অধীনে। আনুমানিক মূল্য ১.২ লাখ কোটি টাকা। এই বিপুল সম্পদ সবই মুসলিমদের ওয়াকফ থেকে এসেছে। অতীত থেকে সকলের কাছে জলের মত স্পষ্ট ওয়াকফ সম্পত্তি মুসলিমদের ধর্মীয় উদ্দেশ্যে আল্লাহর কাছে উৎসর্গ করা সম্পদ।
ওয়াকফ সংশোধনী বিল-২০২৪-এর কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়:
ওয়াকফ আইনের নাম করন থেকে শুরু করে বোর্ডের কমিটি গঠন সকল স্তরে একটা বিরাট পরিবর্তন আনতে চলেছে কেন্দ্র সরকার। এর একমাত্র উদ্দেশ্য সরকারের পক্ষ থেকে ওয়াকফ সম্পত্তির নিয়ন্ত্রণ নেওয়া। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো কেন্দ্র সরকারের এই বিলের সমালোচনা করেছে। সকলের বক্তব্য এটা দেশের সংবিধান ও মুসলিম স্বার্থের পরিপন্থী। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো আরও বলছে ধর্মীয় স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে চায় কেন্দ্র সরকার। তবে সরকার যুক্তি দেখাচ্ছে প্রস্তাবিত সংশোধনী বিলের লক্ষ্য হলো ওয়াকফ সম্পত্তির সঠিক ব্যবহার এবং মুসলিম নারী ও বঞ্চিতদের কল্যাণ। সকলে এটা বুঝতে পারছে বিজেপি সরকারের মুসলিম কল্যাণ চাওয়া মানে মুসলিম অধিকারে হস্তক্ষেপ। কেন্দ্রের শাসক যে পরিবর্তন আনতে চলেছে তার লক্ষ্য কোন অংশে মুসলিম কল্যাণ তা ইতিপূর্বে বেশ কয়েকবার প্রমানিত হয়েছে।
• যে সংশোধনী আনতে চাইছ কেন্দ্রের বিজেপি সরকার তার প্রথম হল ওয়াকফ আইন-১৯৯৫ তুলে দেওয়া। ওয়াকফ আইনের নাম পরিবর্তন করে রাখা হবে ‘ইন্টিগ্রেটেড ওয়াকফ ম্যানেজমেন্ট, এমপাওয়ারমেন্ট, ইফিসিয়েন্সি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অ্যাক্ট'।
• কোন সম্পত্তি ওয়াকফ হিসেবে থাকবেনা। এর দায়িত্ব থাকবে সরকারি আধিকারিকদের হাতে। এর ফলে সমস্ত ক্ষমতা থাকবে জেলা শাসকের হাতে। ওয়াকফ বোর্ডের চেয়ারম্যান থাকবেন একজন দর্শক।
• ওয়াকফ বোর্ডের সদস্যদের নিয়ে যে কমিটি তৈরি হবে সেখানে অবশ্যই দুজন হিন্দু সদস্য রাখতে হবে। যদিও অন্যকোন ধর্মীয় গোষ্ঠীর ক্ষেত্রে এমন নীতি গ্রহণ করা হয়নি। তবে মুসলিমদের ক্ষেত্রে তাদের ধর্মীয় ভাবে স্বীকৃত ওয়াকফ বোর্ডের ক্ষেত্রে এমনটা হবে কেন? এটা কী ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের পরিপন্থী নয়? এই প্রশ্ন উঠেছে।
• নতুন সংশোধনীতে কোন ব্যক্তির সম্পত্তি ওয়াকফ করার ক্ষেত্রে তাকে কমপক্ষে পাঁচ বছর ইসলাম মেনে চলেছেন তার প্রমাণ দিতে হবে। সবচেয়ে অসাংবিধানিক এটাই যে কোন নব মুসলিম ব্যক্তি কিছু ওয়াকফ করতে চাইলে তাকে পাঁচ বছর অপেক্ষা করতে হবে।
বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান:
যুক্তি এবং পাল্টা যুক্তি দিয়ে ক্ষমতাসীন সরকার এবং বিরোধী এই বিল নিয়ে দুই পক্ষই নিজেদের মতামত প্রকাশ করেছে। আগামী শীতকালীন অধিবেশনে সংসদে এই বিল উঠবে বলে মনে করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো অভিযোগ তুলেছেন, এই নতুন বিল অসংবিধানিক। এখানে সরকার খর্ব করতে চাইছে মুসলিমদের সাংবিধানিক অধিকার।কেন্দ্রীয় সংখ্যালঘুমন্ত্রী ইন্ডিয়া মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমিন (এমআইএম)-এর প্রধান আসাদউদ্দিন ওয়েইসি বিলের বিরোধিতা করে বলেছেন, "সাংবিধানিক কাঠামোকে লঙ্ঘন করে এই বিল। এটা বিশেষভাবে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এবং ক্ষমতা পৃথকীকরণকে লঙ্ঘন করে।"
তিনি আরও বলেন, সংশোধিত বিল অনুযায়ী, একমাত্র মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ এবং যারা পাঁচ বছর ধরে এই ধর্ম অনুশীলন করে এসেছেন, তারাই দান করতে পারবেন। কেন তাকে পাঁচ বছর অপেক্ষা করতে হবে? এটা ধর্মে হস্তক্ষেপ নয়?" সমাজবাদী পার্টির অখিলেশ যাদব প্রশ্ন তুলেছেন, "অন্যান্য ধর্মের নিয়ন্ত্রক বোর্ডে যখন ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা স্থান পান না, তাহলে ওয়াকফ বোর্ডে অমুসলিমরা কেন?"
মি. ওয়েইসি বিজেপির বিরুদ্ধে সরাসরি অভিযোগ এনে বলেছেন, “আসলে আপনারা আরএসএসের দাবি জানানো মসজিদগুলোকে, বিভিন্ন হিন্দু সংগঠনের দাবি জানানো দরগাহ কেড়ে নিতে চান। ওয়াকফকে সরিয়ে দিয়ে আপনারা ব্যবহারকারীকে নথি (সম্পত্তির সংশ্লিষ্ট) পেশ করতে বলছেন। ৪০০ বছরের পুরানো নথি যদি না থাকে তাহলে কোথা থেকে আনবে তারা?"
দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী তথা আম আদমি পার্টি (আপ) নেত্রী অতিশী যৌথ সংসদীয় কমিটি (জেপিসি)-কে চিঠি লিখে ওয়াকফ বিলে প্রস্তাবিত সংশোধনীকে বাতিল করার দাবি জানিয়েছিলেন। জেপিসির তরফে বিলের বিষয়ে দিল্লি সরকারের কাছে প্রতিক্রিয়া জানতে চাওয়া হয়েছিল। তারই প্রেক্ষিতে অতিশী বিলটিকে ‘অপ্রয়োজনীয় এবং অন্তঃসারশূন্য’ বলেন।
ওয়াকফ সংশোধনী বিলের বিরোধিতা প্রসঙ্গে বিরোধী দল এবং মুসলিম সংগঠনগুলির যুক্তি, ওয়াকফ বোর্ডের বিভিন্ন সম্পত্তি দখলের উদ্দেশ্যেই ওই বিল আনছে কেন্দ্র। 'জামাআতে ইসলামি হিন্দ' এবং 'অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ডে'র মতো প্রধান মুসলিম সংগঠনগুলির মতে, গেরুয়া শিবির দীর্ঘ সময় ধরেই দিল্লি-সহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ওয়াকফ সম্পত্তি দখল করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। সেই কারণেই তড়িঘড়ি পাশ করাতে চাইছে সংশোধনী বিল।
সবচেয়ে ভাবনার বিষয় গোটা দেশ জুড়ে এক বড়সড় বিতর্কের জন্ম দিতে চলেছে ওয়াকফ সংশোধন বিল-২০২৪। বিশেষত বিজেপি মেরুকরণের রাজনীতিতে সিদ্ধহস্ত। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের বড়ো অংশ মনে করছে বিজেপি এই বিলের মাধ্যমে রাজনৈতিক ফায়দার পাশাপাশি মুসলিমদের ধর্মীয় অধিকারে সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে চাইছে। কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের যুক্তি নাকি মুসলিম সমাজের গরিব এবং মহিলারা ওয়াকফ আইন সংস্কারের দাবি জানাচ্ছে!
COMMENTS